মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৪০ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
নিয়োগকালেও বয়স জালিয়াতি: বিআইডব্লিউটিএর হিসাব সহকারীর কোটি-কোটি টাকার সম্পদ! জাতির পিতার ছবি অবমাননাকারী পেলেন জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার! কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে মাদক মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেফতার কুষ্টিয়া প্রেস ক্লাব কেপিসি’র নবনির্বাচিত পরিষদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে দেশ ছেড়েছেন শামীম ওসমান ডিএমপি কমিশনারকে অবসর দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি আ.লীগ কোনো ভিসানীতির পরোয়া করে না: ওবায়দুল কাদের আগামীতে গণমাধ্যমও ভিসানীতিতে যুক্ত হবে: পিটার হাস কুয়েতে বাংলাদেশিকে হত্যা, গ্রেপ্তার ৪ উপজেলা চেয়ারম্যান সরোয়ারের বাড়িতে স্ত্রী স্বীকৃতির দাবি নিয়ে কৃষি কর্মকর্তা মুক্তা
এই প্রাণ ও সম্পদহানির দায় কার?

এই প্রাণ ও সম্পদহানির দায় কার?

বিশেষ প্রতিনিধি

বিস্ফোরক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বন্দরের অনুমতি নিয়েই তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছিল। বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আলরাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স থেকে রাসায়নিক এনে এখানে রাখা হতো। এখান থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হতো এই রাসায়নিক।

বিএম কনটেইনার ডিপোর ৬০ শতাংশের মালিকানা রয়েছে মুস্তাফিজুর রহমান ও মুজিবুর রহমানের। তারা দুজনই আপন ভাই। এর মধ্যে মুজিবুর রহমান কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক।

সীতাকু- আসনের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম গতকাল ডিপোতে বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে বলেছেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কীভাবে রাসায়নিক ডিপো করা হয়েছে, তা তদন্ত করা উচিত।

কনটেইনার ডিপোর জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। এ ছাড়া লাল ক্যাটাগরির অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে পরিচিত এ ধরনের স্থাপনা করতে অবশ্যই পরিবেশ অধিপ্তরের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিএম কনটেইনার ডিপো এলাকার কাছেই রয়েছে সংরক্ষিত বনভূমি। এটি প্রতিবেশগতভাবে বিপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু ডিপো করার জন্য মালিকপক্ষ বিস্ফোরক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কারোর কাছ থেকেই অনুমতি নেয়নি।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর নাপোরা গ্রামের নজিবুর রহমান মাস্টারের দুই ছেলে মুস্তাফিজুর রহমান ও মুজিবুর রহমান। এরশাদের আমলে তাদের ব্যবসায়িক উত্থান ঘটে। এক সময় বিএনপির অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। আর এখন মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা।

চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডিপোটি কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের জন্য একটি ছাড়পত্র নিয়েছিল। কিন্তু তারা বলেনি সেখানে কেমিক্যাল রাখা হবে। সেখানে কোনো ধরনের রাসায়নিক মজুদ রাখা বেআইনি। এ ধরনের কোনো অনুমতি পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের দেয়নি।’

চট্টগ্রাম বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরক পদার্থ মজুদের কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া যেভাবে থেমে থেমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে তাতে শুধু হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কারণে হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এখানে অন্য আরও কোনো দাহ্য পদার্থ থাকার সম্ভাবনা আছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কীভাবে এখানে দাহ্য পদার্থ রাখার অনুমতি দেয়?’ তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া দাহ্য পদার্থ ভেতরে ঢোকানোর সুযোগ নেই। অথচ এখানে আমাদের কিছুই অবগত করা হয়নি।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য কয়েক দফা মুজিবুর রহমানকে ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) চেয়ারম্যান নূরুল কাইউম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশের ১৯টি বেসরকারি ডিপোর সবক’টি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সনদপ্রাপ্ত এবং এগুলো কমপ্লায়েন্স হিসেবে স্বীকৃত। যে কারণে এখানে সকল আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার নির্ভয়ে রাখা হয়। এখানে গাফিলতি কিংবা নিরাপত্তাজনিত অবহেলার অভিযোগগুলো সঠিক নয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে আলাপে জানা যায়, মুজিবুর রহমানের পারিবারিক মালিকানাধীন শিল্প গ্রুপ স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘বিএম কনটেইনার ডিপো’। এই গ্রুপেরই একটি কেমিক্যাল কারখানা ‘আলরাজি কেমিক্যাল’। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জনবসতি এলাকায় স্থাপিত ওই কারখানায় উৎপাদন হয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নামের কেমিক্যাল। এসব কেমিক্যাল রপ্তানি করা হয় বিভিন্ন দেশে। এই কারখানা থেকে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের একটি চালান রপ্তানির জন্য নিয়ে রাখা হয়েছিল বিএম কনটেইনার ডিপোতে। আর সেই চালানেই ঘটে শনিবারের ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা।

শনিবার রাতে বিভিন্ন ফেইসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে দেওয়া এক বিবৃতিতে স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিএম কনটেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘কী কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা আমরা এখনো নিশ্চিত নই। তবে কনটেইনার থেকেই আগুন ধরেছে বলে ধারণা করছি। নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের পক্ষ থেকে হতাহতদের সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি সকল হতাহতের পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া হবে।’

ডিপোটির নির্বাহী পরিচালক শহীদ উদ্দিন গতকাল বিকেলে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুর্ঘটনা তদন্তে আমাদের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটিকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘এটি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা বা কোনো প্রতিপক্ষ ইচ্ছাকৃত অনিষ্টসাধন (সাবোট্যাজ) করেছে কিনা তাও খতিয়ে দেখার জন্য আমরা সরকারি তদন্ত কমিটির কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’

তথ্য গোপন রাখা হয়: মালিকপক্ষের গাফিলতি ও অসহযোগিতার অভিযোগ করেছেন অগ্নিনির্বাপণ কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাঈন উদ্দিন গতকাল সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ছুটে আসেন। সরাসরি ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে মালিকপক্ষের অসহযোগিতার জন্য তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি বলেন, ‘কোন কনটেইনারে কী কেমিক্যাল (রাসায়নিক) আছে তা জানতে পারলে আমাদের কাজে সুবিধ হতো। কিন্তু এখনো আমরা শনাক্ত করতে পারছি না। এখন পর্যন্ত মালিকপক্ষের কাউকে আমরা পাচ্ছি না।’

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষের কাউকে না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান। এসময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, ‘অগ্নিনির্বাপণ কাজের সুবিধার জন্য ডিপোর কোথায় কী পণ্য রয়েছে তা ফায়ার কর্মীদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের লোকজন থাকা দরকার ছিল। কিন্তু আমি এসেও এখানো ডিপোর কাউকে পেলাম না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ডিপোতে রাসায়নিক ছিল এটা জানা গেলে তারা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু বিএম ডিপোর মালিকরা তাদের কোনো সহায়তা করেনি। এমনকি ডিপোতে কী ধরনের রাসায়নিক ছিল সেটাও তারা বলেনি। এতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।

উল্লেখ্য, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত মারা গেছেন ৯ ফায়ার কর্মী।

জানা গেছে, সেনাবাহিনীর একটি দল বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ‘ফায়ার এক্সপার্ট টিম’। তারা বলছেন, বাতাসে যে রাসায়নিকের মিশ্রণ ঘটেছে তাতে ঝাঁঝালো পদার্থ রয়েছে। ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের চোখ আর গলায় জ্বলাভাব অনুভূত হচ্ছে। তার মানে এখানে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের পাশাপাশি অন্য কোনো ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে।

চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ওয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনিরা চৌধুরী বলেন, ‘একে তো বাতাসের তীব্র গতি তার ওপর বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ থাকার কারণে আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তার ওপর বাতাসটাও বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। কেবল আগুন নেভানোর কাজ সম্পূর্ণ শেষ হলে বোঝা যাবে ভেতরে কী কী রাসায়নিক দ্রব্য আছে।’ তিনি জানান, আগুন নেভাতে ফায়ার কর্মীদের ছোড়া পানি যেন রাসায়নিকের সঙ্গে মিশে সাগরে না মেশে সেদিকে খেয়াল রাখছে সেনাবাহিনী।

পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে: কনটেইনার ডিপোটিতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। এটি যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। তবে ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আর কী কী রাসায়নিক ছিল তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই ফায়ার সার্ভিসের হাতে। এমনকি ডিপোর মালিকরাও এ বিষয়ে তথ্য দিচ্ছে না।

গতকাল সন্ধ্যায় আলরাজি কমপ্লেক্সের ওয়েব সাইটে গিয়ে দেখা যায় সেটি বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলরাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের পাশাপাশি সোডিয়াম সালফেট, সরবিটল ও কস্টিক সোডা তৈরি হতো। সোডিয়াম সালফেট বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে হাঁপানি বা চোখ জ্বালা হতে পারে। আর কস্টিক সোডা বা সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড মানুষের শরীরে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে, এমনকি মানুষ এর সংস্পর্শে এলে অন্ধও হয়ে যেতে পারে।

বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। এতে উদ্ধারকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আশপাশের জনবসতিতে বাসিন্দারা নাখ-মুখ ঢেকে চলাচল করছেন।

ডিপোর আগুনে রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। পানির সঙ্গে মিশে সাগরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এটি থামাতে খালের পানি প্রবাহ বাঁধ দিয়ে আটকে দিয়েছে সেনাবাহিনীর বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিং টিম। বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে খালের পানি বাঁধ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনিরা সুলতানা বলেন, বিষাক্ত রাসায়নিক সাগরে পড়লে পানি ও মৎস্যসম্পদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তাই প্রাথমিকভাবে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে দেওয়া হয়েছে।

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published.




© All rights reserved 2018-2022 khoborbangladesh.com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com