পাবনায় ২০০ বিঘা জমি, ঢাকায় শতকোটি টাকার সম্পদ, দুদকের তদন্তে বাঁধা সৃষ্টি, অর্থ মন্ত্রনালয়ের অসম্মতি সত্ত্বেও পরিচালক এস্টেট পদ সৃজন: কর্মকর্তা ও কর্মচারি বদলীতে নগ্ন হস্তক্ষেপ:
রোস্তম মল্লিক:
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) অফিসার এসোসিয়েশন নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর সরকারী এই সংস্থাটির অঘোষিত ‘‘রাজা” বনে গেছেন অতিরিক্ত পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন। মেতে উঠেছেন বেপরোয়া অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায়। ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলাফেরা করছেন। নিজেকে মনে করছেন বিআইডব্লিউটিএর ছায়া চেয়ারম্যান। তার নির্দেশেই হচ্ছে সব ফাইল ওয়ার্ক। বিশেষ করে কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের বদলী, নিয়োগ,পদায়ন,প্রমোশন, এমন কি তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডারেও হস্তক্ষেপ করছেন। অত্যন্ত দুরদর্শী ও সুচতুর এই কর্মকর্তার চাকুরী জীবনের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিআইডব্লিঊটিএতে যখন যে কর্মকর্তা চেয়ারম্যান পদে বসেছেন তাকেই তিনি নানা কৌশলে ম্যানেজ করে নিজের আয়ত্বে রেখেছেন। তাদেরকে নানা প্রকার আনন্দ বিনোদন দিয়ে বাগিয়ে নিয়েছেন ভাল ভাল পোষ্টিং ও পদন্নোতি। মতাদর্শে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক হলেও তিনি আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকে হাত করে বিআইডব্লিউটিএতে একছত্র আধিপত্য গড়ে তুলেছেন। ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে আয়ের সাথে সংগতিহীন অর্থ-সম্পদ অর্জন করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। প্রায় ৬ বছর ধরে সেটি তিনি ঝুঁলিয়ে রেখেছেন নানা পথে তদবীর করে। এরই মধ্যে আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও ল্যান্ড এস্টেট বিভাগের পরিচালক পদটিও তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন।
একাধিক সুত্রে জানাগেছে, বিআইডব্লিউটিএর বর্তমান চেয়ারম্যানকে ম্যানেজ করে একে এম আরিফ উদ্দিন যা খুশি তাই করে যাচ্ছেন। ফলে এখন সব কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা তাকে ছায়া চেয়ারম্যান হিসাবে গণ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরিফ উদ্দিন নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর এপিএস এর সাথে গড়ে তুলেছেন দহরম মহরম সম্পর্ক। তাদেরকে প্রায় রাজধানীর নামি দামী ফাইভস্টার ও থ্রিস্টার হোটেলে গোপন বৈঠক করতে দেখা গেছে। সেখানে লাল পানি-হানীরও আয়োজন থাকছে। সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানাগেছে, নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের স্মারক নং- ১৮.০০.০০০০.০১৯.১৮.০১৩.২১-২৯৫,তারিখ:২৬ ডিসেম্বর ২০২৩। পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে: উপযুক্ত বিষয় ও সুত্রস্থ পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে মো: মশিউর রহমান তালুকদার উপসচিব স্বাক্ষরিত পত্রে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)-এর সাংগঠনিক কাঠামোতে এস্টেট ও আইন বিভাগের জন্য অর্থ বিভাগ থেকে ১৬/০৮/২০২৩ তারিখের ১৬৮নং স্মারকের মাধ্যমে ১২টি পদ সৃজনে সম্মতি প্রদান করা হয়েছে। পদগুলোর মধ্যে ০২টি উপপরিচালক [উপপরিচালক (এস্টেট)-০১টি, উপপরিচালক (আইন)-০১টি এর পদ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদানের জন্য সরকারের বাজেট সহায়তার উপর নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতিতে, পদ সৃজনে সরকারের আর্থিক সংশ্লেষের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত পরিচালক পদ এবং পরিচালকের সহায়ক পদ হিসেবে ব্যক্তিগত সহকারী এবং অফিস সহায়ক পদ সৃজনে অর্থ বিভাগের অসম্মতি (ঘড়হ-পড়হপঁৎৎবহপব) জ্ঞাপন করা হয়। আইন ও এস্টেট পরিচালক পদ সৃজনে অর্থ মন্ত্রনালয়ের অসম্মতি জানিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় থেকে বিআইডব্লিউটিএ কে পত্র: নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় টি শাখা ১৫ এপ্রিল ২০২৪ এর স্মারক নং- ১৮.০০.০০০০.০১৯.১৮.০১৩.২১.১০৩ এ বিআইডব্লিউটিএ সাংগাঠনিক কাঠামোতে এষ্টেট ও আইন বিভাগের জন্য বছর বছর সংরক্ষনের ভিত্তিতে অস্থায়ী ভাবে ০৩ পদ সৃষ্টিতে সম্মতি জ্ঞাপন সংক্রান্ত একটি পত্র দেন। উক্ত পত্রে অর্থ বিভাগের সূত্র: পত্র নং-০৭.০০.০০০০.১২৬.০০.০০৮ (অংশ-১) ২২.৭৯ তারিখ ২১.৩.২০২৪ এক পত্রে বিআইডব্লিউটিএ সংগাঠনিক কাঠামোতে এষ্টেট ও আইন বিভাগের জন্য ০৩ (তিন) ক্যাটাগরির ০৩ (তিন) টি পদ পরিচালক এর ০১ টি, সাঁটলিপিকারের (ব্যক্তিগত সহকারী) ০১টি এবং অফিস সহকারী ০১টি, রাজস্বখাতে অস্থায়ী ভাবে সৃজনের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রনালয়ের সম্মতি প্রদানের জন্য অর্থ বিভাগ,অর্থ মন্ত্রনালয় গত ১৬-১২-১০২৩ তারিখ অনুরোধ করা হয়। তদপ্রেক্ষিতে অর্থ বিভাগ পদ সৃজনে সরকারের আর্থিক সংশ্লেষের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রম্ভাবিত পরিচালক পদ এবং পরিচালকের সহায়ক পদ হিসেবে ব্যক্তিগত সহকারী এবং অফিস সহকারী এবং অফিস সহায়ক পদ সৃজনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছে। অথচ বিআইডব্লিউটিএ ওয়েব সাইট ঘেঁটে করে দেখা গেছে ল্যান্ড এস্টেট বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হিসেবে এ.কে.এম আরিফ উদ্দিন এর নাম রয়েছে। এবং পরিচালক হিসেবে তিনি যাবতীয় গাড়ী সুবিধা সহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। অর্থ মন্ত্রনালয় থেকে পরিচালক পদ সৃজনের কোন সম্মতি নাই।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য পরিচালক প্রশাসন ওয়াকিল নেওয়াজকে ফোন করলে তিনি ফোন রিসিভ করে নাই। তাহলে প্রশ্ন মন্ত্রনালয় যেখানে পরিচালক পদ সৃজনে অনুমতি দেয় নাই যেখানে বিআইডব্লিউটিএ কিভাবে পরিচালক পদ সৃজন করলো? কার ইশারায় ও কি বিধিতে চলে বিআইডব্লিউটিএ ? এ কে এম আরিফ উদ্দিনের বেতন কত? তার পরিবারের বিআইডব্লিউটিএ চাকুরী পাওয়ার পূর্বে কি পরিমান সম্পত্তি ছিল? তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
দুদকের তদন্তে বাঁধা
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বন্দর ও পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন ওরফে আরিফ হাসনাতের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক (তদন্ত ও তদন্ত-২) হাফিজুল ইসলামকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। টিমের আরেক সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক সুভাষ চন্দ্র মজুমদার। বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (প্রশাসন) বরাবর দুদকের এক চিঠিতে এই তথ্য জানানো হয়। গত ৩ সেপ্টেম্বর দুদকের উপপরিচালক (তদন্ত ও অনুসন্ধান-২) মো. হাফিজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এই চিঠি জারি করা হয়।
চিঠিতে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর এবং ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা নদীবন্দর (সদরঘাট) সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চাওয়া হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর প্রধান কার্যালয়ে কমর্রত আরিফ উদ্দিন ওই সময় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের দায়িত্বে ছিলেন।
চিঠিতে আরিফ উদ্দিন বিআইডব্লিউটিএতে যোগদানের পর থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত তার প্রাপ্ত বেতন-ভাতা এবং তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সংক্রান্ত অফিস আদেশের বিবরণ চাওয়া হয়েছে। আরিফ উদ্দিন ও তার স্ত্রী, সন্তান ও ভাইদের নামে ব্যবসা বা শেয়ার রাখার জন্য আবেদন ও অনুমোদনসংক্রান্ত সব রেকর্ড চেয়েছে দুদক। দুদকের চিঠিতে বলা হয়, চলমান তদন্তের স্বার্থে উপরোক্ত তথ্য চেয়ে চলতি বছরের ৩ আগস্ট বিআইডব্লিউটিএর কাছে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ তা দেয়নি। এ কারণে তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ সেপ্টেম্বর বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (প্রশাসন) বরাবর আরেকটি চিঠি পাঠিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার মধ্যে একই তথ্য ও নথি চাওয়া হয়। তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএ দুদকে কোনো তথ্য পাঠায়নি বলে জানা গেছে। বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (প্রশাসন) কাজী ওয়াকিল নওয়াজ বলেন, গত মাসের ৩ আগস্ট পাঠানো দুদকের কাছ থেকে কোনো চিঠি পায়নি তার কার্যালয় (বিআইডব্লিউটিএ প্রধান কার্যালয়)। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে তার অফিস ইতোমধ্যে দ্বিতীয় চিঠি পেয়েছে, যা ৩ সেপ্টেম্বর পাঠানো হয়েছিল।
চলতি মাসের ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ কেন দুদককে তথ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে- জানতে চাইলে কাজী ওয়াকিল নেওয়াজ বলেন, তিনি এ বিষয়ে কাজ করছেন এবং খুব শিগগিরই দুদকের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবেন বলে আশা করছেন।
আরিফ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কয়েক বছর আগে তার বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কিছুই পাওয়া যায়নি। তিনি আরো বলেন, বেশ কয়েক বছর পর কেউ আবার আমার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ এনেছে। দুদক এখন বিষয়টি তদন্ত করছে। দুদকের অনুসন্ধান শেষ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি তার অনুসন্ধান অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।
এ দিকে বিআইডব্লিউটিএর একাধিক সুত্র জানায়, অতি: পরিচালক আরিফ উদ্দিন হাই ভোল্টেজ তদবীর করে দুদকের তদন্ত ঝুঁলিয়ে রেখেছেন। তিনি এখন রাজনৈতিক তদবীরের মাধ্যমে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
দুদকের হাতে থাকা অভিযোগ থেকে জানাগেছে, এ কে এম আরিফ উদ্দিন তার গ্রামের বাড়ী পাবনা এলাকায় নামে বেনামে কমপক্ষে ২০০ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকাতে তার নিজের ও আত্মীয়-স্বজনদের নামে ১০/১২ টি ফ্ল্যাট ও ৩ টি প্লট রয়েছে। এ ছাড়াও কয়েকটি বেসরকারী শিপিং কোম্পানীতে তিনি প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। দুদক কর্মকর্তারা এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছেন।