ঢাকা ১২:৫৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
সিরাজদিখানে পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সাঃ) উপলক্ষে আলোচনা ও মিলাদ মাহফিল বাগুটিয়া হাটে যান চলাচল বন্ধ, স্থানীয়দের দুর্ভোগ চরমে ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে কোথাও কোন সংখ্যালঘু নির্যাতনের নাটক হয়নি- পঞ্চগড়ে মামুনুল হক প্রভু হতে আসিনী, মানুষের জন্য কাজ করতে চাই- নওগাঁয় নবাগত জেলা প্রশাসক কলেজ ছাত্রীকে নিয়ে ওসি’র রিসোর্ট কান্ড সাবেক এসপিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা অধ্যক্ষ নিয়োগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ জবির ডেপুটি রেজিস্ট্রার আলতাফ এতো টাকা কোথায় পেলেন? বিআইডব্লিউটিএতে সিবিএ ব্যানারে মাজহারুলের দাদাগিরি! মাগুরা মহম্মদপুরে বিএনপির দুই গ্রুপের কোন্দল বাংলাদেশ টু ভারত স্বর্ণ পাচারে জড়িত আওয়ামী লীগের ২১ মন্ত্রী এমপি নেতা!

আতঙ্কের নাম জিয়াউল আহসান

চাকরিচ্যুত সেনাকর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান অনেকের কাছেই মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। শেখ হাসিনার সরকারের সময় নানাভাবে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফোনে আড়ি পেতে কল রেকর্ড ফাঁস, অপহরণ-গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নানা অভিযোগ শোনা গেছে তার বিরুদ্ধে। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও উঠেছিল। এনটিএমসিতে ল-ফুল ইন্টারসেপশন যন্ত্রপাতি কেনাকাটাতে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গেও তিনি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচির এক পর্যায়ে ইন্টারনেট বন্ধ করার নির্দেশদাতাও ছিলেন তিনি।

গতকাল শুক্রবার নিউমার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় জিয়াউল আহসানের ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিব এ আদেশ দেন। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানার এসআই মো. সজিব মিয়া দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। অপরপক্ষে জিয়াউল আহসানের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তাকে আট দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন।

আদালতে রিমান্ড শুনানির সময় জিয়াউল আহসান কিছু বলতে চান। আদালত অনুমতি দেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘গত ৭ আগস্ট আমাকে তুলে নেওয়া হয়। আমি ৮ দিন ধরে আয়নাঘরে ছিলাম। আয়নাঘর আমার সৃষ্টি না। আমি নির্দোষ।’

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার গ্রেপ্তার সম্পর্কে গতকাল শুক্রবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এডিসি (মিডিয়া) মো. ওবায়দুর রহমান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকা থেকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানকে নিউমার্কেট থানায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গত ১৬ জুলাই দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়েশা বেগম (৪৫) মামলাটি করেন। এই মামলায় গত ১৪ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ. রহমান এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে দশ দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সোমবার পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিলুপ্ত করা হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদও। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীতে রদবদল আনা হয়। গত ৬ আগস্ট মঙ্গলবার চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘদিন র‌্যাবে কর্মরত ছিলেন জিয়াউল আহসান। ২০০৯ সালে র‌্যাব-২ এর টুআইসি হিসেবে যোগদান করেন। লে.কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে র‌্যাব সদর দপ্তরে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদে তাকে পদায়ন করা হয়। শাপলা চত্বরের হেফাজতের মহাসমাবেশের সময় তিনি র‌্যাবের অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। এরপর তাকে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) পদে পদায়ন করা হয়। এক বছর পরে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) পরিচালক করা হয়। ২০২১ সালে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়ে এনটিএমসির মহাপরিচালক হন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও গুলির ঘটনায় গত ১৬ জুলাই রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পাপোশের দোকানের কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়শা বেগম (৪৫) একটি মামলা করেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী শাহজাহান আলী নিউ মার্কেট থানাধীন মিরপুর রোডের বলাকা সিনেমা হলের গলির মুখে পাপোশের দোকানে কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো গত ১৬ জুলাই সকাল ৯টার দিকে দোকানে যান তিনি। সেদিন সন্ধ্যায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি মামলার বাদীকে মোবাইল ফোনে জানান যে, শাহজাহান আলী গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য শাহজাহানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে শাহজাহানের মরদেহ শনাক্ত করেন বাদী।

নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ 

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাবেক সেনা ও র‌্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ আদালতে ১৬৪ ধরায় যে জবানবন্দি দেন তাতে তিনি ঘটনার জন্য জিয়াউল আহসানকে দায়ী করেন। জিয়াউল আহসান তখন সেনাবাহিনীর কর্নেল ছিলেন এবং র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই নৃশংস ঘটনার দায় অধীনস্থ তারেক সাঈদের ওপর চাপিয়ে তিনি পার পেয়ে যান।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তারেক সাঈদ বলেন, ‘২০১৪ সালের মার্চে র‌্যাবের অধিনায়কদের মাসিক সম্মেলনের শেষে কর্নেল জিয়া আমাকে একটি তালিকায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। ওই তালিকায় বিভিন্ন মামলার আসামি নজরুলের নাম বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিল। অধিনায়কদের সম্মেলনের পরদিন র‌্যাব-১১-এর কোম্পানি কমান্ডারদের সম্মেলনে আমি নজরুলকে গ্রেপ্তারের জন্য মেজর আরিফকে নির্দেশ দিই। ওই সম্মেলনে আমি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রানাকে, নজরুলকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে মেজর আরিফকে সাহায্য করতে বলি।’

১০ বছর আগে নারায়ণগঞ্জে যে ৭ জনকে হত্যা করে তাদের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয় তাদের অন্যতম হচ্ছন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম। তাকে অপহরণ করার সময় দেখে ফেলার কারণে আইনজীবী চন্দন সরকারসহ অন্য ৬ জনও অপহরণের শিকার এবং পরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। অপহরণের তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে তাদের মরদেহ। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা দেশের মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। সে সময় প্রশ্ন ওঠে, সরকারপ্রধান এবং র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানার বাইরে এই হতাকাণ্ড কীভাবে ঘটতে পারে।

ওই বছরের ১২ মে একটি সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিয়াউল আহসান ৭ খুনে নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম জড়িত কি না, তা-ও খতিয়ে দেখার কথা বলেন। এতে হাইকোর্ট উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, এতে এ হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী শহীদুল ইসলামকে পরোক্ষভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ড তদন্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাজাহান আলী মোল্লাকে প্রধান করে গঠিত প্রশাসনিক কমিটি ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই জিয়াউল আহসানকে চার ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান তিনি। নানা অপকর্মে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকলেও কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, তারপর মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়েছেন তিনি।

অনেক গুম-খুন ও অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা 

জিয়াউল আহসান ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অনেক গুমের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই চার বছর তার ইশারায় চলত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র‌্যাব। ওই সময়ে তিনি র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের প্রধান এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক পরিবেশ আইনবিদ ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আবু বক্কর সিদ্দিককে অপহরণ, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে গুম এবং বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনার সঙ্গেও জিয়াউল আহসানের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে আলোচনা রয়েছে।

এ ছাড়া এনটিএমসির প্রধান হওয়ার পর জিয়াউল আহসান বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের ফোনে আড়ি পাততেন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেন। এনটিএমসিতে ল-ফুল ইন্টারসেপশন যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এনটিএমসির হাজার কোটি টাকার কেনাকাটায় ২০১৭ সালে ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের পিএস হারুন অর রশীদ বিশ্বাস সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাজার কোটি টাকার এই কেনাকাটায় প্রশ্ন তোলায় এবং বাধা দেওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ও বর্তমানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিনকে হেনস্থা করেন তারা। এমনকি স্বরাষ্ট্র সচিব হওয়ার কয়েক মাসের মাথায় কামাল উদ্দিনকে সরিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে বদলি করা হয়। পরে এই সিন্ডিকেট তাদের আজ্ঞাবহ একজন কর্মকর্তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বানায়।

ছাত্র আন্দোলনে ইন্টারনেট বন্ধের ব্যবস্থাও করেন জিয়া 

সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে দেশে গত ১৭ জুলাই (বুধবার) রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। টানা পাঁচ দিন সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল ১০ দিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা বন্ধ ছিল ১৩ দিন। ১৭ জুলাইয়ের আগে দেশে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা আসত প্রধানত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে। কিন্তু মোবাইল অপারেটর সূত্রে জানা যায়, ১৭ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনাগুলো মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা এনটিএমসি থেকেই আসতে থাকে। যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউল আহসান।

মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৭ জুলাই রাত প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে এনটিএমসি থেকে মোবাইল অপারেটরদের বলা হয়, ফেসবুক ও ইউটিউব এনটিএমসির কনটেন্ট ব্লকিং ও ফিল্টারিং ডিভাইসের আওতার বাইরে। এ কারণে অ্যাপ দুটিকে দিবাগত রাত ১২টা থেকে বন্ধ করে দিতে হবে। এর ২ ঘণ্টার মাথায় আবারও এনটিএমসি থেকে সব মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা আসে।

ট্যাগস
জনপ্রিয় সংবাদ

সিরাজদিখানে পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সাঃ) উপলক্ষে আলোচনা ও মিলাদ মাহফিল

আতঙ্কের নাম জিয়াউল আহসান

আপডেট টাইম : ০৬:১৯:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৪

চাকরিচ্যুত সেনাকর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান অনেকের কাছেই মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। শেখ হাসিনার সরকারের সময় নানাভাবে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফোনে আড়ি পেতে কল রেকর্ড ফাঁস, অপহরণ-গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নানা অভিযোগ শোনা গেছে তার বিরুদ্ধে। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও উঠেছিল। এনটিএমসিতে ল-ফুল ইন্টারসেপশন যন্ত্রপাতি কেনাকাটাতে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গেও তিনি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচির এক পর্যায়ে ইন্টারনেট বন্ধ করার নির্দেশদাতাও ছিলেন তিনি।

গতকাল শুক্রবার নিউমার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় জিয়াউল আহসানের ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিব এ আদেশ দেন। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানার এসআই মো. সজিব মিয়া দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। অপরপক্ষে জিয়াউল আহসানের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তাকে আট দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন।

আদালতে রিমান্ড শুনানির সময় জিয়াউল আহসান কিছু বলতে চান। আদালত অনুমতি দেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘গত ৭ আগস্ট আমাকে তুলে নেওয়া হয়। আমি ৮ দিন ধরে আয়নাঘরে ছিলাম। আয়নাঘর আমার সৃষ্টি না। আমি নির্দোষ।’

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার গ্রেপ্তার সম্পর্কে গতকাল শুক্রবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এডিসি (মিডিয়া) মো. ওবায়দুর রহমান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকা থেকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানকে নিউমার্কেট থানায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গত ১৬ জুলাই দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়েশা বেগম (৪৫) মামলাটি করেন। এই মামলায় গত ১৪ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ. রহমান এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে দশ দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সোমবার পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিলুপ্ত করা হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদও। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীতে রদবদল আনা হয়। গত ৬ আগস্ট মঙ্গলবার চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘদিন র‌্যাবে কর্মরত ছিলেন জিয়াউল আহসান। ২০০৯ সালে র‌্যাব-২ এর টুআইসি হিসেবে যোগদান করেন। লে.কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে র‌্যাব সদর দপ্তরে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদে তাকে পদায়ন করা হয়। শাপলা চত্বরের হেফাজতের মহাসমাবেশের সময় তিনি র‌্যাবের অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। এরপর তাকে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) পদে পদায়ন করা হয়। এক বছর পরে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) পরিচালক করা হয়। ২০২১ সালে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়ে এনটিএমসির মহাপরিচালক হন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও গুলির ঘটনায় গত ১৬ জুলাই রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পাপোশের দোকানের কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়শা বেগম (৪৫) একটি মামলা করেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী শাহজাহান আলী নিউ মার্কেট থানাধীন মিরপুর রোডের বলাকা সিনেমা হলের গলির মুখে পাপোশের দোকানে কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো গত ১৬ জুলাই সকাল ৯টার দিকে দোকানে যান তিনি। সেদিন সন্ধ্যায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি মামলার বাদীকে মোবাইল ফোনে জানান যে, শাহজাহান আলী গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য শাহজাহানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে শাহজাহানের মরদেহ শনাক্ত করেন বাদী।

নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ 

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাবেক সেনা ও র‌্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ আদালতে ১৬৪ ধরায় যে জবানবন্দি দেন তাতে তিনি ঘটনার জন্য জিয়াউল আহসানকে দায়ী করেন। জিয়াউল আহসান তখন সেনাবাহিনীর কর্নেল ছিলেন এবং র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই নৃশংস ঘটনার দায় অধীনস্থ তারেক সাঈদের ওপর চাপিয়ে তিনি পার পেয়ে যান।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তারেক সাঈদ বলেন, ‘২০১৪ সালের মার্চে র‌্যাবের অধিনায়কদের মাসিক সম্মেলনের শেষে কর্নেল জিয়া আমাকে একটি তালিকায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। ওই তালিকায় বিভিন্ন মামলার আসামি নজরুলের নাম বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিল। অধিনায়কদের সম্মেলনের পরদিন র‌্যাব-১১-এর কোম্পানি কমান্ডারদের সম্মেলনে আমি নজরুলকে গ্রেপ্তারের জন্য মেজর আরিফকে নির্দেশ দিই। ওই সম্মেলনে আমি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রানাকে, নজরুলকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে মেজর আরিফকে সাহায্য করতে বলি।’

১০ বছর আগে নারায়ণগঞ্জে যে ৭ জনকে হত্যা করে তাদের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয় তাদের অন্যতম হচ্ছন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম। তাকে অপহরণ করার সময় দেখে ফেলার কারণে আইনজীবী চন্দন সরকারসহ অন্য ৬ জনও অপহরণের শিকার এবং পরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। অপহরণের তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে তাদের মরদেহ। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা দেশের মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। সে সময় প্রশ্ন ওঠে, সরকারপ্রধান এবং র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানার বাইরে এই হতাকাণ্ড কীভাবে ঘটতে পারে।

ওই বছরের ১২ মে একটি সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিয়াউল আহসান ৭ খুনে নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম জড়িত কি না, তা-ও খতিয়ে দেখার কথা বলেন। এতে হাইকোর্ট উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, এতে এ হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী শহীদুল ইসলামকে পরোক্ষভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ড তদন্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাজাহান আলী মোল্লাকে প্রধান করে গঠিত প্রশাসনিক কমিটি ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই জিয়াউল আহসানকে চার ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান তিনি। নানা অপকর্মে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকলেও কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, তারপর মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়েছেন তিনি।

অনেক গুম-খুন ও অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা 

জিয়াউল আহসান ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অনেক গুমের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই চার বছর তার ইশারায় চলত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র‌্যাব। ওই সময়ে তিনি র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের প্রধান এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক পরিবেশ আইনবিদ ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আবু বক্কর সিদ্দিককে অপহরণ, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে গুম এবং বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনার সঙ্গেও জিয়াউল আহসানের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে আলোচনা রয়েছে।

এ ছাড়া এনটিএমসির প্রধান হওয়ার পর জিয়াউল আহসান বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের ফোনে আড়ি পাততেন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেন। এনটিএমসিতে ল-ফুল ইন্টারসেপশন যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এনটিএমসির হাজার কোটি টাকার কেনাকাটায় ২০১৭ সালে ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের পিএস হারুন অর রশীদ বিশ্বাস সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাজার কোটি টাকার এই কেনাকাটায় প্রশ্ন তোলায় এবং বাধা দেওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ও বর্তমানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিনকে হেনস্থা করেন তারা। এমনকি স্বরাষ্ট্র সচিব হওয়ার কয়েক মাসের মাথায় কামাল উদ্দিনকে সরিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে বদলি করা হয়। পরে এই সিন্ডিকেট তাদের আজ্ঞাবহ একজন কর্মকর্তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বানায়।

ছাত্র আন্দোলনে ইন্টারনেট বন্ধের ব্যবস্থাও করেন জিয়া 

সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে দেশে গত ১৭ জুলাই (বুধবার) রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। টানা পাঁচ দিন সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল ১০ দিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা বন্ধ ছিল ১৩ দিন। ১৭ জুলাইয়ের আগে দেশে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা আসত প্রধানত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে। কিন্তু মোবাইল অপারেটর সূত্রে জানা যায়, ১৭ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনাগুলো মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা এনটিএমসি থেকেই আসতে থাকে। যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউল আহসান।

মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৭ জুলাই রাত প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে এনটিএমসি থেকে মোবাইল অপারেটরদের বলা হয়, ফেসবুক ও ইউটিউব এনটিএমসির কনটেন্ট ব্লকিং ও ফিল্টারিং ডিভাইসের আওতার বাইরে। এ কারণে অ্যাপ দুটিকে দিবাগত রাত ১২টা থেকে বন্ধ করে দিতে হবে। এর ২ ঘণ্টার মাথায় আবারও এনটিএমসি থেকে সব মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা আসে।