মাগুরা মহম্মদপুর উপজেলায় খোলাবাজারে বিক্রির জন্য বরাদ্দকৃত ওএমএস খাতের ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় দোষী প্রমানিত হওয়ায় আত্বসাৎকৃত ওএমএস ডিলারের লাইসেন্স বাতিল করেছে উপজেলা প্রশাসন। বিভিন্ন দাপ্তরিক সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ১৫ হাজার ৫৬৭ জন উপকারভোগী কার্ড ধারীদের অনুকূল পরিবেশক হোসেনিয়া কান্তা ঋতুর নামে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয় মহাম্মদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস থেকে। এই উপজেলার আটটি ইউনিয়নে হতদরিদ্র টিসিবি কার্ডধারীরা সেই চাউল পাওয়ার কথা থাকলে ও প্রকৃতপক্ষে কেউই সেই চাল পাননি। বরাদ্দের সময় থেকে দেড়মাস সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও চাউল পায়নী গ্রাহকরা। এ কাজে পরিবেশকের নাম জড়িত থাকার কারনে নড়েচড়ে বসে উপজেলা প্রশাসন। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার সাথে জড়িত থাকায় হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে এক ওএমএস ডিলারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। তবে ঘটনাটি জানাজানি হলে বিষয়টি নিয়ে এলাকার সচেতন মহলে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। এদিকে ওএমএস ডিলার থেকে চাল না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন আট ইউনিয়নের আট জন টিসিবির পরিবেশক। তদারকি (ট্যাগ) অফিসার নিজেও ঠিকমত বলতে পারেনী চাউল বিতরন হয়েছে কিনা। তবে ট্যাগ অফিসারের কর্তব্য অনুসারে ফাইলপত্র ঠিক রাখতে তিনি কাগজপত্র স্বাক্ষর করে দিয়েছেন।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায়, জেলা খাদ্য বিভাগের চিঠিতে ১৫ মে, ২০২৫ তারিখে ১৪১ নম্বর স্মারকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) খাতের চার উপজেলার মোট বরাদ্দের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছিল মহম্মদপুর খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস। অফিস রেজিস্টারে দেখা যায় গত জুলাই মাসে ওএমএস পরিবেশক হোসেনিয়া কান্তা ঋতু স্বাক্ষরিত সরকারি গোডাউন থেকে ৫২ কেজির ১ হাজার ৫৩ বস্তা এবং ৩০ কেজির ৮৫৬ বস্তার ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন ২৬ টাকা দরে চাল উত্তোলন করে। এই চাল ৮ ইউনিয়নের ৮ জন টিসিবির পরিবেশকের মাধ্যমে তদারকি (ট্যাগ) অফিসারের উপস্থিতিতে হতদরিদ্র উপকারভোগী কার্ড ধারীদের কাছে ৩০ টাকা দরে ৫ কেজি চাল বিক্রয় করার নিয়ম। এ নিয়ে ৮ ইউনিয়নের ৮ ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিবেদক। এর মধ্যে ছয় জন টিসিবির পরিবেশক জুলাই মাসের বরাদ্দকৃত চাল না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও বিনোদপুর এবং দীঘা ইউনিয়নের দুইজন পরিবেশক চাল পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে অনুসন্ধানে এই দুই ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন টিসিবির কার্ড ধারীরা চাল না পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। একাধিক উপকারভোগীরা বলছেন, টিসিবির ডিলারদের কাছ থেকে তেল, চিনি, ডাল পেলেও চাল পাননি।
রাজাপুর ইউনিয়নের কয়েকজন ভুক্তভোগী আনন্দ, ইলিয়াস , শাকিল হোসেন মোল্লা ও রবিউল ইসলাম জানান, জুলাই মাসে তেল, চিনি, ডাল পেলেও চাল পাননি। চাল নেই কেন জানতে চাইলে পরিবেশক উপকারভোগীকে বলেন এবার সরকার থেকে চালের কোন বরাদ্দ নেই। তারা আরও বলেন, কার্ডে চাল না পেয়ে চাউল বাজার থেকে কিনতে হয়েছে।
রাজার ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ইউনুস আলী এ বিষয়ে বলেন, জুলাই মাসে উপকারভোগীরা চাল কিনতে পারেননি, কারণ ডিলাররা বলেছে বরাদ্দ ছিল না।
দীঘা ইউনিয়নের ভুক্তভোগী অপূর্ব সাহা, কার্তিক সাহা, রনজিৎ ঘোষ বলেন আমরা জুলাই মাসের চাউল পায়নি এছাড়া যখনই যে সরকারই আসে আর যায় সবাই-ই গরিব মানষের চাল নিয়ে ফাকি-ঝুকি মারে।
বিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো: মেজবাউল ইসলাম বলেন, বিনোদপুর ইউনিয়নে প্রায়ই মাঝে মধ্যে শুনি টিসিবিতে চাউল বরাদ্দ নেই । জুলাই মাসে বিনোদপুর ইউনিয়নের কোন টিসিবি কার্ডধারীরাই চাউল পায়নি কারন ডিলার তাদের বলছে চাউল বরাদ্দ নেই। তিনি আরও বলেন যারা গরিবের চাউল না দিয়ে আত্বসাৎ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিৎ।
চাউল আত¦সাতের বিষয়ে মহাম্মদপুর উপজেলা ওএমএস পরিবেশক হোসেনিয়া কান্তা ঋতুর স্বত্বাধিকারী নূর মোহাম্মদের সাথে কথা বললে তিনি প্রথমে অস্বিকার করলেও পরে তিনি নিজ মুখে স্বিকার করেন এবং বলেন তিনি নিজেই স্বাক্ষর করে চাউল উত্তোলন করেন এবং সেটি টিসিবির কোন ডিলারকেই দেননি।
টিসিবির পরিবেশক সান্টু সাহা বলেন, গত জুলাই মাসে চালের বরাদ্দ আমরা পাইনি। তবে অফিস বলেছে, জুলাই মাসের চাল দেওয়া হবে।
মহম্মদপুর উপজেলা সদরের টিসিবি কার্ডধারী মো: ফরিদ বিশ^াষ, জাহাঙ্গির আলম, আবুল বাসার, আব্দুল হাকিম বিশ^াষ, পান্নু মিয়া ও ফরহাদ আলীর সাথে কথা বললে তারা বলেন, জুলাই মাসে সরকারের পক্ষ থেকে চাউল বরাদ্দ দেয়া হয়নি বলে তাদের টিসিবির ডিলার জানিয়ে দেন। টিসিবির চাউল না পেয়ে তারা বাজার থেকে চড়া দামে চাউল ক্রয় করেছেন।
মহম্মদপুর উপজেলা সদরের টিসিবির পন্য প্রদানের সময় দায়িত্বে থাকা ট্যাগ অফিসার উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার (এটিও) প্রদীপ লস্কর বলেন, জুলাই মাসের বরাদ্দকৃত চাল টিসিবির ডিলাররা কার্ড ধারীদের কাছে বিক্রয় করেছে কি না সেটি তার মনে নেই। তবে, ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে এবং কাগজপত্র দেখে জানাতে পারব। তবে কাগজপত্র স্বাক্ষর করে দিয়েছি।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসার মজনুর রহমান বলেন, আমাদের দায়িত্ব ওএমএসের ডিলারের নিকট চাউল বুঝে দেওয়া । চাউল ঠিকমত পরিবেশন করা হয়েছে কিনা সেটি আমার দেখার দায়িত্ব নেই। চাউল আত্বসাতের সাথে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমরা জুলাই মাসের বরাদ্দকৃত চাল ওএমএসের ডিলারকে আমাদের পক্ষ থেকে বুঝিয়ে দিয়েছি।
মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিনুর আক্তার জানান, আমি বিষয়টি জানতে পেরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে তদন্ত করে ঘটনার সাথে জড়িত প্রমানিত হওয়ায় ওই উপজেলা ওএমএস ডিলার হোসেনিয়া কান্তা ঋতুর ডিলারশিপ বাতিল করা হয়েছে। সেই সাথে আত্বসাৎকৃত চাউল সরকারী কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।