স্টাফ রিপোর্টার :
ঢাকা কাস্টমস হাউস প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে। অথচ টাকার অভাবে গত এক বছর ধরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাদের নিজস্ব গুদামের সিসিটিভি মেরামত বা নতুন করে কিনতে পারেনি। ফলে সিসিটিভি অকেজো থাকার সুযোগ নিয়ে গুদামের আলমারির ৫৫ দশমিক ৫১ কেজি সোনা গায়েব করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সোনা গায়েবের তদন্তে নামলে সামনে আসে সিসিটিভি বিকলের বিষয়টি। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি গুদামে যেনতেনভাবে কোটি কোটি টাকার মালামাল বছরের পর বছর রাখার বিষয়টি হতবাক করেছে পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্টদের।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, স্বর্ণের বার ও অলংকারসহ দামি অনেক জিনিস রাখা হয় কাস্টমসের গুদামে। ফলে এর নিরাপত্তায় ২০১৩ সালে স্থাপন করা হয় বেশ কিছু ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা। কিন্তু দীর্ঘদিন সচল থাকার পর গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মেরামতের উদ্যোগ নিলে অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা ছাড় দেয়নি।
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যয় স্থগিত করে একটি পরিপত্র জারি করে। সেখানে বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয় কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে অর্থ বিভাগ থেকে এর আগে জারিকৃত স্মারক ও পরিপত্রের অনুবৃত্তিক্রমে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ব, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাজাটের কতিপয় খাতসমুহে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় স্থগিত/হ্রাসকরণের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ পরিপত্রের কারণেই অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা ছাড়েনি বলে দাবি কাস্টমস কর্তৃপক্ষের।
জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা আজাদ আজ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘২০১৩ সালে লাগানো সিসিটিভি নষ্ট হয়ে গেছে। আমি গত বছর থেকে নতুন সিসি টিভি লাগানোর চেষ্টা করেও পারিনি। কারণ বাজেট থাকলেও টাকা খরচে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে গতকাল (বুধবার) ১০টি সিসিটিভি ক্যামেরি লাগিয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘সোনা চুরির এ দায় আমি এড়াতে পারি না। তবে আমিই কিন্তু সাহস করে বিষয়টি সামনে এনেছি। পুলিশের কাছে গেছি প্রকৃত দোষীদেও খুঁজে বের করতে। এতে অনেকে আমার সমালোচনা করছেন। যেন চোর ধরতে গিয়ে নিজেই বিপাকে পড়ছি। এমন হলেতো কেউ ভবিষ্যতে এমন সাহসী উদ্যোগ নেবে না।’
তিনি বলেন. সোনা চুরির বিষয়টির প্রাথমিক তথ্য আমার কাছে আসে গত ২১ তারিখে (২১ অক্টোবর)। এরপর আমি তাৎক্ষণিক গুদামে থাকা স্বর্ণের বার ও স্বর্ণালংকার গণনার উদ্যোগ নিয়েছি। এর পর যখন চুরির বিষয়টি প্রমাণ হয় আমিই পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছি এমন ঘটনা ভবিষ্যতে যেন না ঘটে সে জন্য।’
এদিকে সোনা চুরির মামলাটি বিমানবন্দও থানা থেকে গত মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু ডিবি এখনো কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। কাস্টমসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও কোনো ক্লু পাচ্ছে না বলে দাবি তদন্ত-তদারকি কর্মকর্তাদের। গতকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তারও দেখায়নি ডিবি।
জানতে চাইলে ডিবি উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার বদরুজ্জামান জিল্লু বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের হেফাজতে যে আটজন আছে তারা কোনো কিছুই বলতে পারছে না। তারা দাবি করছে ঘটনাটি চুরি এবং তাদেও কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
তাদের গ্রেপ্তার করা হবে কি-না জানতে চাইলে বলেন, ‘কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাদের আমাদের কাছে দিয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া আমরা তো তাদেও গ্রেপ্তার দেখাতে পারব না।’
কাস্টমস সূত্র বলছে, গত ২১ আগস্ট সোনা গায়েবের প্রাথমিক তথ্য কাস্টমস কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা জানার পরদিন সোনা গণনা ও পরীক্ষার উদ্যোগ নেন। কাস্টমসের সহকারী কমিশনার (বিচার) মো. আতিকুজ্জামান চৌধুরী দুজন বিশেষজ্ঞ চেয়ে বাংলা গোল্ড (প্রা.) লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে চিঠি দেন। এই চিঠির প্রেক্ষিতে গোল্ড এনালিস্ট অমিত ধর ও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার রনি সোনা গণনা ও পরীক্ষা করে। এ সময় ধরা পরে ৫৫.৫১ কেজি সোনা আলমারিতে কম আছে।
এ ঘটনা তদন্তে দুই দফা কমিটি গঠন করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে ১১ সদস্যের যার সভাপতি করা হয়েছে, কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার কাজী ফরিদ উদ্দীন আর সদস্যসচিব করা হয়েছে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা প্রিভেন্টিভ মোহাম্মদ সোহরাব হোসেনকে। এ ছাড়া দুজন যুগ্ম কমিশনার, দুজন ডেপুটি কমিশনার, একজন রাজস্ব কর্মকর্তা ও চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। কমিটিকে বলা হয়েছে, ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে।