আমিনুল হীরা:
শিমুলতলায় শিমুল ও একজন মহিলা
শিমুল শিমুল গাছের নিচেই দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে অদূরে একটি বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকত, এই তাকিয়ে থাকার মাঝে মনে লুকিয়ে থাকা ভীষণ শুন্যতা তুলার মতো হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়,
শিমুল কখনো এই শিমুলের তুলো দিয়ে চোখ মুছে,
তেমন জল নেই চোখে বোঝা মুশকিল সেকি আদো কাঁদছে কিনা,
তবে তার ভিতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা শিমুল ছাড়া কারো বোঝার সাধ্য নেই।
শিমুলের বয়স আট কিংবা নয়, তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে,
সবার মাঝে শিমুল অন্যরকম চুপচাপ,
ওর চোখের ভাষা আছে, চাহনিতে মায়া আছে,
স্কুলের পাশেই বয়ে যাওয়া ছোট্ট দীঘি তার পাশেই সারিসারি শিমুল গাছ ,
শীতের সৌন্দর্য।
এই সৌন্দর্যের মাঝেই একরাশি আর্তনাদ মনের মধ্যে পুষিয়ে রাখতো শিমুল,
প্রতিদিন টিফিন সময় কেউ বাড়ি যায় খাবারখেতে,
আবার কারো মা কিংবা বাবা এসে খাবার দিয়ে যেত।
কিন্তু শিমুল এসবের বালাই নেই ,
এই সময়টুকু দাঁড়িয়ে থাকত ওই বাড়িটির দিকে তীর্থ কাকের মত,
শকুনের তীক্ষ্ণ চোখের মতন ঝরেপড়া শিমুল ফুলের গুচ্ছ নিয়ে
মাঝেমাঝে খেলা করে পার করত সময়
কিন্তু চোখজোড়া বাড়ির জুড়ে, মনে হয় বাড়িটি ওর চোখের ভিতর।
টিফিনের ঘন্টা শেষ শিমুল শুস্ক ঠোঁটে,
দাঁতের ভিতর দাঁত ঢুকিয়ে নির্বাক হয়ে ক্লাসে ফিরে যায়।
এভাবেই মাস চলে যায় শিমুলের পেটে দুপুরের খাবার পড়েনা,
শিমুলের গাছের সাথে বেশ সখ্যতা তৈরি হয়েছে,
দু’জন দু’জনকে বন্ধুর মত বোঝে।
কারণ দু’জন্ই কারো না কারো জন্য অপেক্ষা করছে।
কিছুদিন পর স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট দীঘির জল শুকিয়ে যায়,
ঝোড়ো হওয়ায় শিমুল গাছ দুমড়ে মচকে ভেঙে পড়ে
যে জায়গাটি শিমুল দাঁড়িয়ে থাকতো ঠিক সেখানেই,
এদিকেশিমুলআরস্কুলেআসেনা,
যে বাড়ির দিকে শিমুল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো
ওই বাড়ি থেকে একজন ভদ্র মহিলা শিমুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে স্কুলপানে তাকিয়ে থাকত,
এরই মধ্যেই শোনা যায় শিমুল এখানে আর নেই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য জায়গায়,
শিমুল যে কয়দিন ওই শিমুল গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকতো দুপুর বেলায়
সে কয়দিন ওই ভদ্র মহিলা বাড়ির আঙিনার পাশে কাজ করার জায়গা করে নিয়েছিল
যাতে শিমুলকে দেখাযায়, আজ শিমুল নেই মহিলার চোখে অশ্রু।
ওই বাড়ি থেকে ডাক পড়ায় ভদ্র মহিলা চলে যায় আর ফিরে তাকায়,
শিমুল গাছের সৌন্দর্য নেই শিমুলের আর্তনাদের দেহ পড়ে আছে নিঃস্বদের কাতারে,
যাদের কেউ থাকেনা এই সমাজ যে স্থানকে বলে ইয়াতিমখানা।
সেখানে শিমুল ভালো নেই, শিমুলের মনটানে এই শিমুলতলায়।
শিমুল নেই শিমুল তলাও নেই ,
ভরে গেলো দীঘি মহিলার চোখের অশ্রুতে।
কেউ ভালো নেই, হয়তো শিমুল ফিরবে গুছিয়ে যাবে মহিলার অশ্রু, জাগবে নতুন করে শিমুলতলা।
সময়ের সাথে সাথে শিমুলের শরীর ভীষণ খারাপের দিকে চলে যায়,
মহিলার চোখের অশ্রু শুকিয়ে যায়,
শিমুলের দেহখানা নিস্তেজ হতে থাকে,
চোখগুলো বড় হতে থাকে
মুখ ফুটে পাশে থাকা এক সহপাঠীকে বলে ওঠে
-নিয়ে যাবি আমায় শিমুল তলায়,
যেখানে আমার মায়ের আঙিনা,
শিমুল তলা থেকে একটু দূরে যে বাড়িটা যেখানে আমার মা থাকে।
-তুই তোর মায়ের কাছে থাকতি না।
– থাকতে চাইতাম কিন্তু যারা আমায় এখানে রেখে গেছে তারা যেতে দিতোনা।
আমাকে নিয়ে যাবি?
দেখবি ওই বাড়িয়ে আঙিনায় সুন্দর যে মহিলা শিমুলতলার দিকে তাকিয়ে আছে সে আমার মা।
শিমুলের মু’খানা ফ্যাকাশে হয়ে যায়, চোখজোড়া বন্ধ যায় এক নিমিষেই,
সহপাঠী ডেকে ওঠে কিন্তু শিমুল আর ওঠেনা বিভোর ঘুম।
আকাশে কালোমেঘ, সুমদ্রে জাহাজ চলছে কালোপতাকা উড়িয়ে যেন এদিকেই আসছে,
শিমুল এই জাহাজেই পারি দেবে অদূরে যেখানে শিমুলের গল্প শুরুর কথক আছে।