ঢাকা ১১:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
সিরাজদিখানে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহীদদের স্মরণে দোয়া মাহফিল মুন্সীগঞ্জে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি ও সাবেক নেত্রীবৃন্দের স্বরণে দোয়া ও আলোচনা সভা টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে মুক্তিযোদ্ধা দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন গাজীপুরে চাঁদার দাবিতে বাড়ি ঘর ভাংচুরের অভিযোগ গোপালগঞ্জের হালিমের কথায় চলছে নন্দী পাড়া ভুমি অফিস গাজীপুরে StepUp অ্যাপ- এর প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালা অনুষ্ঠিত আদমদীঘিতে মাদকসেবনের দায়ে চার জনকে ভ্রাম্যমাণ দিল ইউএনও আগরতলায় হাইকমিশনে হামলায় বাংলাদেশের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া গাজীপুরে অনুর্ধ ১৭ ফুটবল খেলায় বিকেএসপি ২-১ গোলে হারালো গাজীপুরকে সান্তাহার রেলওয়ে এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে বাবা-মেয়ের মৃত্যু

মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নিয়ে এতো অনাসৃষ্টি কেন?

রোস্তম মল্লিক :

‘অপারেশন জ্যাকপট’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবময় ঘটনা। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের নৌ-কমান্ডো অভিযান বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করতে নৌ-কমান্ডোদের ভূমিকা ছিল অনন্যসাধারণ। এ অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র ও রসদবাহী উল্লেখযোগ্য জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অচল হয়ে যায় নদীবন্দর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জলপথে চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই গেরিলা অভিযান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সুষ্টি করে।

জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শত প্রকার প্রচেষ্টা ও দাবীর প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবময় ঘটনা ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রকল্প গ্রহন করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বরাদ্দ করা হয় ৪১ কোটি টাকা। আর এই টাকার ওপর লোলুপদৃষ্টি পড়ে কতিপয় টাউট বাটপার শ্রেনির কিছু ধান্দাবাজ ব্যক্তির। তারা যেনতেন ভাবে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করে টাকাগুলো হরিলুট করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামে। সাকসেসও হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধূ কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর আশীর্বাদে তারা দ্রুততার সাথে প্রকল্পের কার্যাদেশ পেয়ে যায়। তখন এ বিষয়ে বাঁ সেধে বসেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম । তিনি এ বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে একটি রীট পিটিশন দায়ের করেন। তখন এ বিষয়ে নিচের এই সংবাদটি ছাপা হয়েছিল ইংরেজি দৈনিক এশিয়ান এজ পত্রিকায়। খবরে লেখা হয়, ‘অপারেশন জ্যাকপট চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। মূলত, অপারেশন জ্যাকপট ছিল ১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর একটি সমন্বিত ও সফল বিধ্বংসী নৌকমান্ডো অপারেশন, যা ১৫ আগষ্ট মধ্যরাতের পর চারটি নৌবন্দরে একযোগে পরিচালিত হয়েছিল। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম প্রথমে অপারেশন জ্যাকপট এর ইতিহাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন। কিছুটা বিতর্কিতভাবে, পরে ছবিটির নির্মান কাজ দরপত্র সূত্রে কিবরিয়া ফিল্মসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল; খুব বেশি ব্যাখ্যা ছাড়াই, যিনি দেলোয়ার জাহান ঝন্টুকে পরিচালক হিসাবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এখন হাইকোর্ট এই দরপত্র সম্পর্কিত সমস্ত কার্যক্রম তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে। কিবরিয়া ফিল্মসের কাছে কেন কাজটি হস্তান্তর করা হয়েছে তার জবাব চেয়ে রুল জারি করেন বিচারক।বিচারপতি মাহমুদুল হক ও বিচারপতি মো: মাহমুদ হাসান তালুকদার এসব নির্দেশ দেন।
প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল, যেখানে সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান, এমপি; সাবেক সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি; সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি যৌথভাবে গিয়াস উদ্দিন সেলিমের কাছেই প্রকল্পটি হস্তান্তর করেছিলেন।’
সে যাই হোক, এশিয়ান এজ পত্রিকায় ওই খবরটি ছাপা হওয়ার পর গত এক বছরে বুড়িগঙ্গা নদীতে পানি গড়িয়েছে অনেক। জানা যায়, সেই মামলার বিষয়টি এক পর্যায়ে অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত গড়ায় এবং সুবিজ্ঞ আদালত দুই দফায় ৬ মাস করে ছবিটির সকল কার্যক্রমের উপর স্থিতাবস্থার আদেশ দেন। তা স্বত্ত্বেও ছবিটির স্যুটিং শুরু হয়েছে এবং কিবরিয়া ফিল্মস এর পরিবর্তে তা করছে সিনেমার সাথে সম্পর্কহীন এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি- অন্তরা শোবিজ। এতে পরিচালক করা হয়েছে বাংলাদেশের দেলোয়ার জাহান ঝন্টু এবং ভারতের রাজিব কুমার বিশ্বাসকে।
মুক্তিযুদ্ধে তীব্র আলোড়ন তোলা মুক্তিবাহিনীর বিধ্বংসী নৌকমান্ডো অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে সরকারী উদ্যোগে নির্মীয়মান ঐতিহাসিক এই ছবির অসঙ্গতি সম্পর্কে ইতোমধ্যে নানা মহলে কথা উঠেছে। এটি নির্মানের জন্য আহবান করা টেন্ডার, টেন্ডারের শর্ত খেলাপ করে বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান, টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী কর্তৃক চলচ্চিত্রায়ণের সার্বিক দায়িত্ব পালন, চিত্রনাট্যে গুরুতর ইতিহাস বিকৃতি, অসঙ্গতি, চলমান মামলা এবং ইতিহাস কাঁপানো এই ছবি পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া পরিচালকদের যোগ্যতা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

এই ছবির মূখ্য পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। তিনি এদেশের স্বনামধন্য একজন সিনেমা পরিচালক। তার কিছু ছবির নাম- নাগরানী, রূপসী নাগিন, নাচে নাগিন বাজে বীণ, নাচ নাগিনা নাচ, বিষে ভরা নাগিন, দুই নাগিন, সাথী হারা নাগিন, নাচ রূপসী, হাতী আমার সাথী, শশী পুন্নু, জাঁদরেল বৌ, স্ত্রীর স্বপ্ন, ভাবীর সংসার, রূপের রানী গানের রাজা, প্রেমগীত, ডাকাত, দেশী রংবাজ, বাঘা বাঘিনী, বিজলী তুফান- ইত্যাদি। এই নামগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি চলচ্চিত্র মাধ্যমে আজীবন কি ডেলিভারী দিয়ে এসেছেন। একটিও আর্ট ফিল্ম বা তার ধারে কাছে কিছু নেই; নেই ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণে বক্তব্য নির্ভর কোন সৃষ্টিশীল ছবি। বরং ওগুলো সবই পোষাকী, রিপু-উত্তেজক এবং স্রেফ বিনোদন আমদানীর সহায়ক; বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বানানো ফ্যান্টাসী চিন্তার ধারক। সমাজ সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন কখনও যার উদ্দেশ্য ছিল না। এই অভিজ্ঞতা ও মনোবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিকে অপারেশন জ্যাকপট -এর মত ভয়ংকর যুদ্ধজয়ের ইতিহাস নির্ভর রিয়েলিস্টিক চলচ্চিত্রের পরিচালক মনোনীত করা হয়েছে কোন চিন্তা থেকে তা জানেন কেবল সংশ্লিষ্টরা।
অপরদিকে, যে ভারতীয় পরিচালকের নাম জানা গেছে, বাস্তবে তিনিও আরেক দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর বেশি কিছু মনে হয় না। তার পরিচালিত ছবিগুলোর নাম দেখলে তেমনটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। তার ছবির নামগুলো- পাগলু, বিক্রম সিংহ দ্য লায়ন, বিন্দাস, ইডিয়ট, খোকা, পাওয়ার, লাভ এক্সপ্রেস, তোমাকে চাই, রাজা রাণী রাজি, নাকাব- ইত্যাদি। দুর্ভাগ্য যে, এদের হাতেই কিনা তুলে দেয়া হয়েছে আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে গর্বিত ইভেন্ট, নৌকমান্ডো অপারেশন জ্যাকপট সেলুলয়েড বন্দি করার মহান দায়িত্ব।
জানা যায়, মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া অন্তর শোবিজ এর চিত্রনাট্য নিয়ে গত আগষ্ট মাসে একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সভায় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো এসোসিয়েশন চিত্রনাট্যের বিভিন্ন গুরুতর অসঙ্গতি, ইতিহাস বিকৃতি, বাহুল্য ফ্যান্টাসী আমদানীর ঘটনা নিয়ে লিখিত আপত্তি জানিয়েছিল। তাতে বাস্তব ভিত্তিক কিছু সুপারিশও করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সব আপত্তি বা সুপারিশেরগুলোর ব্যাপারে কোন সংশোধনীর উদ্যোগ না নিয়েই নির্মাতা কোম্পানি স্যুটিং আরম্ভ করেছে। তার কিছু ভিডিও এবং স্টিল ফটোগ্রাফ অনলাইনে আপলোড করা হলে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্যুটিংয়ের ক্লিপিংগুলোতে দেখা গেছে, ওই অপারেশন পরিকল্পনায় থাকা বাস্তবতার সাথে চলচ্চিত্রায়িত দৃশ্যের আকাশ পাতাল পার্থক্য। আবার প্রকৃত ঐতিহাসিক ঘটনাও বিকৃত করা হয়েছে। তার পরিবর্তে টেনে আনা হয়েছে মনের মাধুরী মেশানো দৃশ্য পরিকল্পনা। এই সব অসঙ্গতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র অপারেশন জ্যাকপট চলচ্চিত্রায়নের কাজ। প্রশ্ন হলো, চলচ্চিত্রের কাজ একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করছে কিভাবে? আর মন্ত্রণালয়ই বা কিভাবে তা অনুমোদন করে?
মহান মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র অপারেশন জ্যাকপট অবশ্যই নির্মিত হোক। তবে তা হোক সুদক্ষ হাতে; নৌকমান্ডো অপারেশনের অজানা অবিকল তথ্যের সমাহার নিয়ে; জাতির অকুতোভয় বীর সন্তান নৌকমান্ডোদের অমলিন আত্মত্যাগের প্রকৃত ইতিহাস বুকে ধারণ করে। ছবিটি নির্মিত হোক একাত্তরে দুনিয়া কাঁপানো সেই অপারেশনটির মতই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রাঙ্গণে আলোচিত হওয়ার মানসম্পন্ন হয়ে। একদা যেমন নির্মিত হয়েছিল প্রাক-মুক্তিযুদ্ধকালের মাস্টারপিস- ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্র। নির্মীয়মান এই ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র কোন মতেই কোন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের চলচ্চিত্র নির্মাণ শেখার আইটেম বানানো যেতে পারে না। সরকারের ২১ কোটি টাকা লুটপাটের এই আযোজন এখনি বন্ধ করা উচিত বলে মনে করছেন জীবিত থাকা নৌ-কমান্ডো ও বীর মুক্তিযোদ্ধাগন।

ট্যাগস
জনপ্রিয় সংবাদ

সিরাজদিখানে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহীদদের স্মরণে দোয়া মাহফিল

মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নিয়ে এতো অনাসৃষ্টি কেন?

আপডেট টাইম : ১২:০৭:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

রোস্তম মল্লিক :

‘অপারেশন জ্যাকপট’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবময় ঘটনা। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের নৌ-কমান্ডো অভিযান বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করতে নৌ-কমান্ডোদের ভূমিকা ছিল অনন্যসাধারণ। এ অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র ও রসদবাহী উল্লেখযোগ্য জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অচল হয়ে যায় নদীবন্দর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জলপথে চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই গেরিলা অভিযান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সুষ্টি করে।

জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শত প্রকার প্রচেষ্টা ও দাবীর প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবময় ঘটনা ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রকল্প গ্রহন করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বরাদ্দ করা হয় ৪১ কোটি টাকা। আর এই টাকার ওপর লোলুপদৃষ্টি পড়ে কতিপয় টাউট বাটপার শ্রেনির কিছু ধান্দাবাজ ব্যক্তির। তারা যেনতেন ভাবে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করে টাকাগুলো হরিলুট করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামে। সাকসেসও হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধূ কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর আশীর্বাদে তারা দ্রুততার সাথে প্রকল্পের কার্যাদেশ পেয়ে যায়। তখন এ বিষয়ে বাঁ সেধে বসেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম । তিনি এ বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে একটি রীট পিটিশন দায়ের করেন। তখন এ বিষয়ে নিচের এই সংবাদটি ছাপা হয়েছিল ইংরেজি দৈনিক এশিয়ান এজ পত্রিকায়। খবরে লেখা হয়, ‘অপারেশন জ্যাকপট চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। মূলত, অপারেশন জ্যাকপট ছিল ১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর একটি সমন্বিত ও সফল বিধ্বংসী নৌকমান্ডো অপারেশন, যা ১৫ আগষ্ট মধ্যরাতের পর চারটি নৌবন্দরে একযোগে পরিচালিত হয়েছিল। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম প্রথমে অপারেশন জ্যাকপট এর ইতিহাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন। কিছুটা বিতর্কিতভাবে, পরে ছবিটির নির্মান কাজ দরপত্র সূত্রে কিবরিয়া ফিল্মসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল; খুব বেশি ব্যাখ্যা ছাড়াই, যিনি দেলোয়ার জাহান ঝন্টুকে পরিচালক হিসাবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এখন হাইকোর্ট এই দরপত্র সম্পর্কিত সমস্ত কার্যক্রম তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে। কিবরিয়া ফিল্মসের কাছে কেন কাজটি হস্তান্তর করা হয়েছে তার জবাব চেয়ে রুল জারি করেন বিচারক।বিচারপতি মাহমুদুল হক ও বিচারপতি মো: মাহমুদ হাসান তালুকদার এসব নির্দেশ দেন।
প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল, যেখানে সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান, এমপি; সাবেক সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি; সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি যৌথভাবে গিয়াস উদ্দিন সেলিমের কাছেই প্রকল্পটি হস্তান্তর করেছিলেন।’
সে যাই হোক, এশিয়ান এজ পত্রিকায় ওই খবরটি ছাপা হওয়ার পর গত এক বছরে বুড়িগঙ্গা নদীতে পানি গড়িয়েছে অনেক। জানা যায়, সেই মামলার বিষয়টি এক পর্যায়ে অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত গড়ায় এবং সুবিজ্ঞ আদালত দুই দফায় ৬ মাস করে ছবিটির সকল কার্যক্রমের উপর স্থিতাবস্থার আদেশ দেন। তা স্বত্ত্বেও ছবিটির স্যুটিং শুরু হয়েছে এবং কিবরিয়া ফিল্মস এর পরিবর্তে তা করছে সিনেমার সাথে সম্পর্কহীন এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি- অন্তরা শোবিজ। এতে পরিচালক করা হয়েছে বাংলাদেশের দেলোয়ার জাহান ঝন্টু এবং ভারতের রাজিব কুমার বিশ্বাসকে।
মুক্তিযুদ্ধে তীব্র আলোড়ন তোলা মুক্তিবাহিনীর বিধ্বংসী নৌকমান্ডো অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে সরকারী উদ্যোগে নির্মীয়মান ঐতিহাসিক এই ছবির অসঙ্গতি সম্পর্কে ইতোমধ্যে নানা মহলে কথা উঠেছে। এটি নির্মানের জন্য আহবান করা টেন্ডার, টেন্ডারের শর্ত খেলাপ করে বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান, টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী কর্তৃক চলচ্চিত্রায়ণের সার্বিক দায়িত্ব পালন, চিত্রনাট্যে গুরুতর ইতিহাস বিকৃতি, অসঙ্গতি, চলমান মামলা এবং ইতিহাস কাঁপানো এই ছবি পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া পরিচালকদের যোগ্যতা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

এই ছবির মূখ্য পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। তিনি এদেশের স্বনামধন্য একজন সিনেমা পরিচালক। তার কিছু ছবির নাম- নাগরানী, রূপসী নাগিন, নাচে নাগিন বাজে বীণ, নাচ নাগিনা নাচ, বিষে ভরা নাগিন, দুই নাগিন, সাথী হারা নাগিন, নাচ রূপসী, হাতী আমার সাথী, শশী পুন্নু, জাঁদরেল বৌ, স্ত্রীর স্বপ্ন, ভাবীর সংসার, রূপের রানী গানের রাজা, প্রেমগীত, ডাকাত, দেশী রংবাজ, বাঘা বাঘিনী, বিজলী তুফান- ইত্যাদি। এই নামগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি চলচ্চিত্র মাধ্যমে আজীবন কি ডেলিভারী দিয়ে এসেছেন। একটিও আর্ট ফিল্ম বা তার ধারে কাছে কিছু নেই; নেই ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণে বক্তব্য নির্ভর কোন সৃষ্টিশীল ছবি। বরং ওগুলো সবই পোষাকী, রিপু-উত্তেজক এবং স্রেফ বিনোদন আমদানীর সহায়ক; বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বানানো ফ্যান্টাসী চিন্তার ধারক। সমাজ সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন কখনও যার উদ্দেশ্য ছিল না। এই অভিজ্ঞতা ও মনোবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিকে অপারেশন জ্যাকপট -এর মত ভয়ংকর যুদ্ধজয়ের ইতিহাস নির্ভর রিয়েলিস্টিক চলচ্চিত্রের পরিচালক মনোনীত করা হয়েছে কোন চিন্তা থেকে তা জানেন কেবল সংশ্লিষ্টরা।
অপরদিকে, যে ভারতীয় পরিচালকের নাম জানা গেছে, বাস্তবে তিনিও আরেক দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর বেশি কিছু মনে হয় না। তার পরিচালিত ছবিগুলোর নাম দেখলে তেমনটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। তার ছবির নামগুলো- পাগলু, বিক্রম সিংহ দ্য লায়ন, বিন্দাস, ইডিয়ট, খোকা, পাওয়ার, লাভ এক্সপ্রেস, তোমাকে চাই, রাজা রাণী রাজি, নাকাব- ইত্যাদি। দুর্ভাগ্য যে, এদের হাতেই কিনা তুলে দেয়া হয়েছে আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে গর্বিত ইভেন্ট, নৌকমান্ডো অপারেশন জ্যাকপট সেলুলয়েড বন্দি করার মহান দায়িত্ব।
জানা যায়, মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া অন্তর শোবিজ এর চিত্রনাট্য নিয়ে গত আগষ্ট মাসে একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সভায় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো এসোসিয়েশন চিত্রনাট্যের বিভিন্ন গুরুতর অসঙ্গতি, ইতিহাস বিকৃতি, বাহুল্য ফ্যান্টাসী আমদানীর ঘটনা নিয়ে লিখিত আপত্তি জানিয়েছিল। তাতে বাস্তব ভিত্তিক কিছু সুপারিশও করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সব আপত্তি বা সুপারিশেরগুলোর ব্যাপারে কোন সংশোধনীর উদ্যোগ না নিয়েই নির্মাতা কোম্পানি স্যুটিং আরম্ভ করেছে। তার কিছু ভিডিও এবং স্টিল ফটোগ্রাফ অনলাইনে আপলোড করা হলে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্যুটিংয়ের ক্লিপিংগুলোতে দেখা গেছে, ওই অপারেশন পরিকল্পনায় থাকা বাস্তবতার সাথে চলচ্চিত্রায়িত দৃশ্যের আকাশ পাতাল পার্থক্য। আবার প্রকৃত ঐতিহাসিক ঘটনাও বিকৃত করা হয়েছে। তার পরিবর্তে টেনে আনা হয়েছে মনের মাধুরী মেশানো দৃশ্য পরিকল্পনা। এই সব অসঙ্গতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র অপারেশন জ্যাকপট চলচ্চিত্রায়নের কাজ। প্রশ্ন হলো, চলচ্চিত্রের কাজ একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করছে কিভাবে? আর মন্ত্রণালয়ই বা কিভাবে তা অনুমোদন করে?
মহান মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র অপারেশন জ্যাকপট অবশ্যই নির্মিত হোক। তবে তা হোক সুদক্ষ হাতে; নৌকমান্ডো অপারেশনের অজানা অবিকল তথ্যের সমাহার নিয়ে; জাতির অকুতোভয় বীর সন্তান নৌকমান্ডোদের অমলিন আত্মত্যাগের প্রকৃত ইতিহাস বুকে ধারণ করে। ছবিটি নির্মিত হোক একাত্তরে দুনিয়া কাঁপানো সেই অপারেশনটির মতই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রাঙ্গণে আলোচিত হওয়ার মানসম্পন্ন হয়ে। একদা যেমন নির্মিত হয়েছিল প্রাক-মুক্তিযুদ্ধকালের মাস্টারপিস- ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্র। নির্মীয়মান এই ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র কোন মতেই কোন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের চলচ্চিত্র নির্মাণ শেখার আইটেম বানানো যেতে পারে না। সরকারের ২১ কোটি টাকা লুটপাটের এই আযোজন এখনি বন্ধ করা উচিত বলে মনে করছেন জীবিত থাকা নৌ-কমান্ডো ও বীর মুক্তিযোদ্ধাগন।