সকল মন্ত্রণালয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সংস্কার ও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও শিল্প মন্ত্রণালয়ে আজো তার কোন প্রতিফলন দৃশ্যত হয়নি। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মো: আদিলুর রহমানের উদাসীনতা এবং পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আস্থাভাজন সচিব জাকিয়া সুলতানার স্বেচ্ছাচারিতায় মন্ত্রণালয়টি আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের অভয়স্থলে পরিণত হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের অধিনে রয়েছে ১৫ টি অধিনস্থ সরকারী সংস্থা। অধিদপ্তর ও অন্যান্য সংস্থাগুলো হলো: চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেড, পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর,ক্ষুদ্র, মাইক্রো ও কুটির শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমসিআইএফ), ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানী লিমিটেড (ডিএপিএফসিএল), স্মল এন্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ ফাউন্ডেশন (এসএমইএফ),বাংলাদেশ এ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড, প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়,বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক), ন্যাশনাল প্রোডাকটিভিটি অর্গানাইজেশন (এনপিও)।এসব সংস্থাগুলো দেশের শিল্প উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। বিশেষ করে বিসিআইসি,বিসিক,বিটাক ও বিএসটিআই। এই সব সংস্থায় শীর্ষ ও মধ্যম পদে যারা কর্মরত রয়েছেন তারা সকলেই বিগত অর্ধযুগকাল আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী। তারা অবৈধ পথে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ী,মার্কেট, ফ্ল্যাট,প্লট ও জমা জমি ক্রয় করেছেন। প্রচার আছে যে এসব সংস্থায় ঘুস ছাড়া কোন ফাইল স্বাক্ষর হয় না।
৫ আগষ্ট পরবর্তী অন্তর্বতীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশবাসী আশা করেছিল যে,এবার বুঝি এই সব সরকারী অফিসগুলো ঘুস-দুর্নীতিমুক্ত হবে। আর যারা দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে আওয়ামী সুবিধা ভোগ করছে তাদের শাস্তি হবে। কিন্তু দেশবাসীর সেই আশার গুড়ে বালি পড়েছে। এই মন্ত্রণালয়ে এমন একজন ব্যাক্তিকে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে যিনি সংস্কারের ক্ষেত্রে শতভাগ উদাসীন। কেবল উদাসীনই নন,তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে আওয়ামী প্রীতিও দেখাচ্ছেন।
মো: আদিলুর রহমান শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহন করার পর এই মন্ত্রণালয়টি ঝিমিয়ে পড়েছে। হারিয়েছে কার্যক্রম গতি। কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মধ্যের চেইন অব কমান্ডও ভেংগে পড়েছে। সচিব জাকিয়া সুলতানা যা খুশি তাই করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে উপদেষ্টা মো: আদিলুর রহমান বসে বসে সমুদ্রের ঢেউ গুনছেন। মন্ত্রণালয় ও অধিনস্থ দপ্তরগুলো হতে গত ৪ মাসেও তিনি আওয়ামী সুবিধবাদী কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের সরাতে পারেন নি। ফলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ দপ্তরগুলোতে আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা মহাদাপটের সাথে অবস্থান করছেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে যে,দেশের শাসন ক্ষমতার কোন পরিবর্তনই ঘটেনি।
আরো একটি মজার বিষয় হলো- শিল্প মন্ত্রণালয়ে ও তার অধিনস্থ দপ্তরগুলোর কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে বা সংবাদপত্রে সংবাদ ছাপা হলেই তাকে শাস্তির বদলে প্রাইজ পোষ্টিং দেওয়া হচ্ছে। এ এক আজিব কান্ড! এমন ঘটনা অন্য কোন মন্ত্রণালয়ে বিরল হলেও শিল্প মন্ত্রণালয়ে সেটির দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হচ্ছে বারংবার। যেমন: চলতি বছরের অক্টোবর মাসে শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মুহা: নুরুল আমিন খানের বিরুদ্ধে ৫/৬টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। তিনি আওয়ামীপন্থি একজন আমলা। শিল্প মন্ত্রণালয়ে এক নাগাড়ে ১৪/১৫ বছর চাকুরি করছেন। তার বাড়ীও গোপালগঞ্জ জেলায়। ঘুস ছাড়া কোন ফাইল ছাড়তেন না। তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদগুলোর পেপার কার্টিং সহ জনপ্রশাসন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার পর এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন না করে বা ওএসডি না করে একই মন্ত্রণালয়ে আরো ভালো উইং এ প্রাইজ পোষ্টিং দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বিস্মিত হন মন্ত্রণালয়ের দেশ প্রেমিক কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা। তারা চরম হতাশগ্রন্থ হয়ে পড়েন।
সুত্র জানায়,যুগ্ম সচিব মুহা: নুরুল আমিন খানের বিরুদ্ধে উল্লেখিত বিষয় নিয়ে বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা তাকে সেইভ করার জন্য গত ৭ অক্টোবর শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিএবি ও বয়লার শাখায় বদলী করেছেন। যার স্মারক নং ৩৬.০০.০০০০.০৪৬.১১.০৪২.১৯.৯৩০। এ ঘটনায় আরো ক্ষুব্ধ হয়েছেন কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা। তাদের প্রশ্ন: স্বৈরাচার শেখ হাসিনার এলাকার (গোপালগঞ্জ) এর কর্মকর্তার জন্য শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানার এতো দরদ কেন? কেন তাকে ওএসডি করা হচ্ছে না। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার আমলেও কিভাবে গোপালগঞ্জের লোকেরা এতটা সুবিধা পাচ্ছেন। তবে কি শিল্প মন্ত্রণালয়ে শর্ষের মধ্যেই ভুত রয়েছে?
একইভাবে বিসিক এর (পরিচালক প্রশাসন) বেগম শ্যামলী নবীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ স্ববিস্তরে ৫/৬টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি না করে বা তাকেও ওএসডি না করে বিসিক প্রধান কার্যালয় থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব প্রশাসন পদে প্রাইজ পোষ্টিং দেওয়া হয়েছে। যার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় স্মারক নং উনি-২, ০৫.০০.০০০০.১৩১.০০.১৮৯.২৪.১০২০ তাং ০৯/১২/২০২৪ ইং।
অপরদিকে মুন্সীগঞ্জে নির্মাণাধীন বিসিকের কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রি শিল্প পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো: হাফিজুর রহমান সীমাহীন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ও তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় তাকে পিডি পদ থেকে সরিয়ে নতুন পিডি নিয়োগের জন্য তিনজন কর্মকর্তার নাম শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠান বিসিক চেয়ারম্যান। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেটি ডীপফ্রীজে ফেলে রাখা হয়েছে। প্রায় এক মাস অতিবাহিত হলেও সেই নতুন পিডি নিয়োগের ফাইল স্বাক্ষর করেন নি উপদেষ্টা মো: আদিলুর রহমান ও সচিব জাকিয়া সুলতানা। শোনা যাচ্ছে প্রকল্প পরিচালক মো: হাফিজুর রহমানের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তাকেই স্বপদে বহাল রাখা হয়েছে।
এ দিকে ০১ জানুয়ারি ২০২৫ পিআরএল অবসরে যাবেন এমন একজন কর্মকর্তা মো: নিজাম উদ্দিনকে অবসরে যাওয়ার মাত্র ২ মাস আগে পিডি পদ থেকে সরাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে বিসিক ও শিল্প মন্ত্রণালয়। আক্রোশবসত: একই মাসে তাকে দুইবার পিডি পদ থেকে অপসারণ করে আদেশ জারি করা হয়েছে অথচ: তাকে স্বীয় পদ মর্যাদায় কোথাও পোষ্টিং দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় বিপাকে পড়েছেন সচিব জাকিয়া সুলতানা ও উপদেষ্টা মো: আদিলুর রহমান।
সরকারি চাকরী বিধি অমান্য করে গায়ের জোরে অন্যায়ভাবে তাকে পিডি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করায় ওই প্রকল্প পরিচালক মহামান্য হাইকোর্টে রীট মামলা দায়ের করেছেন। রীট মামলা নং ১২১২০/২০২৪। এই মামলায় মহামান্য আদালত শিল্প মন্ত্রণালয়ের ওই আদেশ স্থগিত করেছেন।
এ দিকে সেই স্থগিত আদেশের বিরুদ্ধে চেম্বার জজ আদালতে সিভিল পিটিশন ফর লীভ টু আপীল নং ৩৮৬২/২০২৪ দায়ের করেন বিসিক চেয়ারম্যানের পক্ষে প্যানেল ‘ল‘ ইয়ার। দি¦তীয়বার উভয় পক্ষের শুনানী শেষে বিজ্ঞ চেম্বার কোর্টের বিচারপতি রীট মামলা নং ১২১২০/২০২৪ পিডি মো: নিজাম উদ্দিনের রীট মামলার স্থগিত আদেশের কার্যকরিতা ৮ সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে আদেশ দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- অবসরে যাওয়ার মাত্র ২ মাস আগে পিডি মো: নিজাম উদ্দিনকে প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিলো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা সরাসরি শেখ হাসিনার লোক বলে সচিবালয়ে পরিচিত। শেখ হাসিনার সাথে তার ওয়ান টু ওয়ান সম্পর্ক থাকায় ১৪৭ জন আমলাকে ডিংগিয়ে জাকিয়াকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে বসানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধিনে নির্মাণাধীন থাকা বিসিক এর ৫ টি শিল্প নগবী প্রকল্পের শত শত কোটি টাকা লোপাট করা। আর সেই জন্য শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা আওয়ামী লীগের নেতাদের সমন্বয়ে একটি ঠিকাদারী সিন্ডিকেট গঠন করেছিলেন। তিনি শিল্প সচিব পদে বসেই ওই সব সিন্ডিকেট ঠিকাদারদের শত শত কোটি টাকার কাজ দিতে পিডিদের মৌখিক নির্দেশ দেন।
এদিকে অন্য সব পিডিরা সচিব জাকিয়া সুলতানার এমন অন্যায় আবদার মেনে নিলেও পিডি মো: নিজাম উদ্দিন মেনে নেন নি। তিনি পিপিআর শর্তের আলোকে স্বচ্ছভাবে টেন্ডার আহবান করে ঠিকাদার নির্বাচন করে কার্যাদেশ দেন। আর এতেই ক্ষিপ্ত হন শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা। তিনি প্রকল্পের পিডি পদ থেকে মো: নিজাম উদ্দিনকে সরিয়ে দিতে নির্দেশ দেন বিসিক চেয়ারম্যান ও পরিচালক প্রশাসনকে। আর সচিব জাকিয়া সুলতানার আক্রোশমূলক হুকুম তামিল করতে গিয়েই বিসিক চেয়ারম্যান ও পরিচালক প্রশাসন একটার পর একটা বেআইনী আদেশ জারি করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন,মহামান্য হাইকোর্টে মামলা চলমান থাকায় এ বিষয়ে তিনি কোন কথা বলতে পারবেন না