“ছোট হয়ে জন্মেছিলাম বড় হবো বলে, কিন্তু হয়ে দেখি আমি সেই ছোটই রয়ে গেলাম।”
এটি শুধু একটি বাক্য নয়, এটি মানবজীবনের এক চিরন্তন আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মপ্রবঞ্চনা এবং আত্মউন্মোচনের দরজা। আমরা সবাই জন্মাই শূন্য হাতে, স্বপ্ন নিয়ে। আমরা ভাবি, একদিন বড় হবো—জ্ঞানী, শ্রদ্ধেয়, সফল, গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অনেকেই আবিষ্কার করি—আমরা বড় হতে গিয়ে আসলে নিজের ‘ছোটত্ব’ আরও প্রকট করে ফেলেছি।
বিশ্বের মনীষীরা এই চিরন্তন দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কী বলেছেন?
• সক্রেটিস (গ্রিস): “I know that I know nothing.”
• লাও ত্সু (চীন): “He who knows that enough is enough will always have enough.”
• স্যাঁত-এক্সুপেরি (ফ্রান্স): “What is essential is invisible to the eye.” — The Little Prince
• ইমাম গাজ্জালি (পারস্য): “A man’s worth is in what he seeks.”
• গীতার বাণী (ভারত): “উত্তম সে, যে নিজের উপর বিজয় লাভ করে।” (গীতা, ৬:৬)
এইসব মনীষীদের কথাগুলো আমার জীবনেও নানা সময়ে নতুন করে অর্থ পেয়েছে। বিশেষ করে একটি অভিজ্ঞতা, যা আমাকে শেখায়—জীবনে যত বড়ই হও না কেন, ‘ছোট’ হওয়ার শিল্প না শিখলে বড়ত্ব অর্থহীন হয়ে পড়ে। যেমন ইসলামি পরিপ্রেক্ষিতে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি বাণী আছে—
“যে বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহ তাকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেন।” (সহীহ মুসলিম)
এ এক অনন্ত সত্য—বিনয় ও আত্মজিজ্ঞাসার মধ্যেই বড়ত্বের মূল নিহিত।
আমি পেশাগত জীবনে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি কোম্পানিতে সাপ্লাই চেইন এবং প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি। নেতৃত্ব, কৌশল, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা—সবকিছু দিয়েই চেষ্টা করেছি ‘বড়’ কিছু গড়ে তুলতে। কিন্তু একদিন একটি ছোট্ট সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সময় লক্ষ্য করলাম—আমার কিছু সহকর্মী আমার ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নিয়ে অস্বস্তি বা অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। বিষয়টি আমাকে ভেতরে ভেতরে নাড়া দিল। মনে হলো, এত বছরের অভিজ্ঞতা, এত পরিশ্রম—তবু আমি কি এখনো কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নই?
ঠিক সেই সময়ে আমার মনে পড়ে গেল সুইডিশ টেনিস কিংবদন্তি বিয়ন বার্গ–এর একটি বাস্তব ঘটনা, যার আমি নিজেই প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
আমার মেয়ে জেসিকা এবং বিয়নের ছেলে লিও বার্গ তখন সুইডেনের প্রতিনিধিত্ব করে একটি আন্তর্জাতিক টেনিস টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল। আমি গ্যালারিতে বসে তাদের খেলা দেখছিলাম। লিও সেদিন নিজের খেলায় মন দিতে পারছিল না—তার মধ্যে যেন অস্থিরতা কাজ করছিল। একপর্যায়ে বিয়ন, একেবারেই শান্ত গলায়, ছেলেকে বললেন: “খেলায় একটু মনোযোগ দাও, লিও।” এই নিরীহ উপদেশের জবাবে লিও রাগ এবং বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল— “বাবা, দয়া করে চুপ থাকো। তুমি টেনিস সম্পর্কে কিছুই জানো না।”
আমি তখন বিয়নের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে আমার দিকে তাকালেন এবং মৃদু হাসিতে বলে উঠলেন— “মাত্র ছয়বার উইম্বলডন জিতেছি… এখন আমার ছেলের চোখে আমি টেনিস সম্পর্কে কিছুই জানি না।”
বিয়নের এই আত্মনম্র, সংযত প্রতিক্রিয়া আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। একটি মুহূর্তে জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনও যেন কারও চোখে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে। আমি হঠাৎ উপলব্ধি করলাম—জীবনের সব অভিজ্ঞতা, সফলতা কিংবা ‘বড়’ হয়ে ওঠার গল্প, সবকিছুই ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে যদি কেউ অন্তরে সত্যিকারের নম্রতা না ধারণ করে।
লিও হয়তো সেদিন জানত না সে কী বলছে, কিংবা কেন বলছে। হয়তো তার মনজুড়ে তখন প্রতিযোগিতার চাপ, হতাশা, এবং নিজের অক্ষমতার প্রতি ক্ষোভ কাজ করছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে একজন কিংবদন্তির নীরবতা এবং একজন পিতার ব্যথায় মোড়ানো হাসি—আমার জন্য হয়ে উঠেছিল এক গভীর শিক্ষার নাম।
সেদিন মনে হয়েছিল— “পরাজিতরা খোঁজে অজুহাত, আর বিজয়ীরা খোঁজে সমাধান।” কিন্তু তার চেয়েও বড় উপলব্ধি ছিল— বড় হওয়া মানে নিজেকে বড় করে তোলা নয়, বরং অন্যের চোখে ছোট হয়ে গেলেও নিজেকে হারিয়ে না ফেলা।
‘বড়’ হওয়ার অর্থ কী?
আজকের সমাজে বড় হওয়া মানে হলো—উচ্চপদস্থ চাকরি, অঢেল অর্থ, খ্যাতি, অনুগামী, ‘স্ট্যাটাস’। কিন্তু এগুলো হচ্ছে ‘প্রকাশ্য বড়ত্ব’। সত্যিকারের বড়ত্ব লুকিয়ে থাকে—
• বিনয়ে
• ত্যাগে
• সহানুভূতিতে
• আত্মপ্রশ্নে
• এবং নিজেকে প্রতিদিন একটু করে বদলানোর চেষ্টায়
সত্যিকার বড় মানুষ তার নিজের ভেতর বড় হয়, বাইরের চাকচিক্যে নয়।
আধুনিক জীবনে এই বার্তার গুরুত্ব
মানুষ আজ চাঁদে যাচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বানাচ্ছে, অথচ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। আমরা যত প্রযুক্তিতে, দৌড়ে, বাহ্যিকতায় বড় হচ্ছি, ততই নৈতিকতা, সহানুভূতি আর আত্মসমালোচনায় ছোট হয়ে যাচ্ছি। আমরা ভুলে গেছি— “ছোট হয়েও যে নিজের বিবেককে অতিক্রম করে না, সে-ই আসলে সবচেয়ে বড়।”
“ছোট হয়ে জন্মেছিলাম বড় হবো বলে, কিন্তু হয়ে দেখি আমি সেই ছোটই রয়ে গেলাম।” এই আত্মোপলব্ধির মধ্যে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। এই বাক্য আমাদের ব্যর্থতা নয়, জাগরণ হোক। বড় হতে চাইলে শুরু করতে হবে ‘ছোট’ কাজ দিয়ে—অহং ত্যাগ, অন্যকে শ্রদ্ধা, নিজের ভুল স্বীকার, এবং প্রতিদিন একটু করে আরও ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা।
বড় হওয়া মানে নিজেকে ‘উঁচু’ ভাবা নয়—বরং অন্যকে বড় দেখার ক্ষমতা অর্জন।
রহমান মৃধা, প্রবাসী বাঙালি
গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com