পৃথিবীতে মানুষের শারীরিক উপস্থিতি স্বল্পকালীন।কিন্তু মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না,কেউ যদি মহৎ,সাহসী ও কল্যাণমূলক অবদান রাখে,সে-ই প্রতিষ্ঠিত হয় ইতিহাসের পাতায়। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় ,’পৃথিবীতে এসেছিস, দাগ কেটে যা’- এই দাগ যিনি রেখে যান,তিনি বেঁচে থাকেন সবার মাঝে তাঁর কর্মের মাধ্যমে। বারবারা জিল ওয়াল্টার্স।বেঁচে আছেন তাঁর কর্মের মাধ্যমে।তিনি বারবারা ওয়াল্টার্স নামে সুপরিচিত।বারবারা ওয়াল্টার্স একজন আমেরিকান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব,গবেষক,সাংবাদিক ও লেখক।তিনি টেলিভিশন সংবাদ সম্প্রচারের একজন পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত।কর্মজীবনে অনেক উল্লেখযোগ্য সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।তিনি ৫০ বছরের বেশি সময় গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।১৯৬১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদভিত্তিক টিভি নেটওয়ার্ক এবিসি নিউজে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন বারবারা।১৯৭৪ সালে এনবিসির একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমেরিকার প্রথম নারী সহ-উপস্থাপক হিসেবে নাম লেখান তিনি। এরপর থেকে তাঁর কর্মজীবনে ও সাংবাদিকতার অধ্যায়ে রচনা করেছেন অসংখ্য সাহসিকতার গল্প।প্রাইমটাইম শো ২০/২০ উপস্থাপনা করেন তিনি। তাঁর মাধ্যমেই টিভি সাংবাদিকতায় নারী সমাজের পদার্পণ ঘটে।তাঁকে সম্প্রচার গণমাধ্যমে নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বলা হয়। বারবারা ওয়াল্টার্স ১৯৯৭ সালে নারীদের নিয়ে ‘দ্য ভিউ’ নামে একটি শো শুরু করেন। ইহা খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে ১২ বার অ্যামি অ্যাওয়ার্ড এবং বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি এবং সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন বারবারা ওয়াল্টার্স।
নিরপেক্ষতা, গভীর প্রশ্ন করার ক্ষমতা,সাংবাদিকতার নীতিমালার সঠিক মূল্যায়ন ও শ্রদ্ধাবোধ,বস্তুনিষ্ঠতা এবং পেশাদারিত্বের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন।নিখুঁত সংবাদ সংগ্রহ এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা সহজ কাজ নয়।সত্যকে বের করে আনতে হয় নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল দিয়ে এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে হয় নিজস্ব সততা, সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।এ ধরনের সাংবাদিকতায় কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব চলে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাদারিত্ব দেখিয়ে কাজ করতে হয়।গণমাধ্যমে সাহসিকতা,নিজস্ব বুদ্ধি, প্রজ্ঞা,নিরপেক্ষতা ও অনুসন্ধানী মানসিকতা নিয়ে যারা এই কাজগুলো করে বিশ্বে অনেক সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তাদেরকে বিশ্ববাসী আজও শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করে।
বারবারা ওয়াল্টার্স তাঁদের মধ্যে অন্যতম:
তিনি নিরপেক্ষতা,বিচক্ষণতা এবং গভীর প্রশ্ন করার ক্ষমতার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।বিশ্ব বরেণ্য বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, রাজনৈতিক, সামাজিক,বিনোদন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি।বারবারা ওয়াল্টার্স প্রায় ৭০০ স্বনামধন্য ও বিখ্যাত মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।’আমি সাক্ষাৎকার নিতে ভয় পাই না’,এ সংলাপ ছিল সাংবাদিক বারবারা ওয়াল্টার্সের ট্রেডমার্ক। তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়ার বিশেষ সাহসিকতা ও বৈশিষ্ট্য ছিল বলেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘আপনার কি কখনও নিজের ওপর সন্দেহ হয়েছিল?’ ভ্লাদিমির পুতিনকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘আপনি কি চান কাউকে হত্যা করা হোক?’ সততা,সাহসী সাংবাদিকতা, দক্ষতা ও ভদ্রতার সঙ্গে সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তিনি খুব জনপ্রিয় ও পারদর্শী ছিলেন।১৯৯৯ সালে বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিউইনস্কির স্মৃতিকথন নিয়ে বারবারার উপস্থাপনা ৭০ মিলিয়ন মানুষ উপভোগ করেছিল। তিনি সাক্ষাৎকারে সংবাদ সংস্থা এপিকে বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করি মানুষ আমাকে সৎ ও সাহসি সাংবাদিক হিসেবে স্মরণ করবে। আমি যেসব সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি তা হবে ইতিহাসের সাক্ষী।তাঁর মাধ্যমে টেলিভিশন সাংবাদিকতায় নারীদের পদচারণা শুরু হয়েছিল বলে তাঁকে নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বলা হয় ।সাংবাদিকতার এই বিশ্ব বাতিঘর বারবারা ওয়াল্টার্স ভ্লাদিমির পুতিন,ডোনাল্ড ট্রাম্প, রিচার্ড নিকসন, ফিদেল কাস্ত্রো,মার্গারেট থ্যাচার,মনিকা লিউইনস্কি, ইন্দিরা গান্ধী,মার্ক জুকারবার্গ, ক্যাথরিন হেপবার্ন,মাইকেল জ্যাকসনসহ বিশ্ব বরেণ্য বিভিন্ন পেশার মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্বনেতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণে বারবারা ওয়াল্টার্স নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, উপস্থিত বুদ্ধি,বিচক্ষণতা ও শৈল্পিক গুণের কারণে প্রচুর সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেন।বারবারা ওয়াল্টার্সের গ্রহণ করা বিশ্ববরেণ্য লোকদের সাক্ষাৎকারগুলো তাঁর সাংবাদিকতার প্রতিভা এবং গভীর অনুসন্ধানী মানসিকতার পরিচয় বহন করে।তিনি সম্প্রচার মাধ্যমে নারীদের মধ্যে সর্বাধিক বেতন ভোগ করেছেন বলে মিলিয়ন ডলার নিউজওম্যান হিসেবে পরিচিত পান।বারবারা ওয়াল্টার্স তাঁর বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত জীবন, চিন্তা-ভাবনা, এবং দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে এবং দর্শকদের জানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।এই দাপুটে গণমাধ্যম কর্মী, লেখক ও গবেষক ১৯২৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর,আমেরিকার বোস্টনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর কর্ম,অবদান এবং বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবন,নির্ভীক সাক্ষাৎকার গ্রহণের কৌশল, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, নারীদের জন্য সংবাদমাধ্যমে পথ সুগম করার বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন ইত্যাদি কারণে ইতিহাস তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।তিনি আগামী প্রজন্ম এবং নারী সমাজের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
শাহ মনসুর আলী নোমান
গবেষক,শিক্ষা প্রশাসক ও কলাম লেখক,
সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার,নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।