আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের পর এবার দুর্র্নীতি দমন কমিশনের তিন মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার পূর্বাচলের নতুন শহর প্রকল্পে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির পৃথক তিন মামলায় শেখ হাসিনাকে ৭ বছর করে মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন। শুধু হাসিনা নয়, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকেও ৫ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও ১৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার। মামলার পর্যবেক্ষণে বিচারক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি অভিযুক্ত তিনজনের প্লট বাতিল করে ভূমিহীন ও যোগ্য আবেদনকারীদের মধ্যে পুনরায় বরাদ্দের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি সরকারি প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়কে ‘বিশেষ সুপারিশের বিধান’ অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। দণ্ডের পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে এক লাখ টাকা করে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৬ মাস করে ১৮ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড; পুতুল ও জয়কে দণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৬ মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
যে কারণে যাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড: আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঢাকা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরেও সেই তথ্য গোপন করে তারা আইন ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা আকারের একটি করে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। পূর্বাচলের ২৭ নম্বর সেক্টরের কূটনৈতিক জোনের ২০৩ নম্বর সড়কের আশপাশে এসব প্লটের অবস্থান। আর এ অপরাধে সম্পৃক্ত থাকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনকে দুই মামলায় ৬ বছর করে মোট ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে এক লাখ টাকা করে মোট ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে দেয়া হয়েছে ছয় মাস করে এক বছরের কারাদণ্ড। সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদকে তিন মামলায় ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ৬ মাস করে দেড় বছরের কারাভোগ করতে হবে তাকে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার ও কাজী ওয়াছি উদ্দিনকেও একই সাজা ভোগ করতে হবে। গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদারকে তিন মামলায় এক বছর করে মোট ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে। পাঁচ, দশ ও পাঁচ হাজার টাকা করে মোট ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক মাস করে তিন মাস কারাভোগ করতে হবে তাকে। রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞাকে তিন মামলায় দেয়া হয়েছে পাঁচ বছর করে মোট ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। ৫০ হাজার টাকা করে মোট দেড় লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও তিন মাস করে ৯ মাসের কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছে।
রাজউকের সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনকে তিন মামলায় ৩ বছর করে মোট ৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ২০ হাজার টাকা করে মোট ৬০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও দুই মাস করে ৬ মাস কারাভোগ করতে হবে তাকে। রাজউকের আরেক সাবেক সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর প্রকৌশলী সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরীকেও একই সাজা দেয়া হয়েছে। রাজউকের সাবেক সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) শফি উল হককে এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও দুই মাস কারাভোগ করতে হবে তাকে। সংস্থার আরেক সাবেক সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদকেও একই সাজা দেয়া হয়েছে।
রাজউকের সাবেক সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাসকে দুই মামলায় ৩ বছর করে মোট ৬ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও দুই মাস করে চার মাস কারাভোগ করতে হবে তাকে। রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) নুরুল ইসলামকেও দুই মামলায় একই সাজা দেয়া হয়েছে। রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) শেখ শাহিনুল ইসলামকে এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও দুই মাস কারাভোগের সাজা দেয়া হয়েছে তাকে। রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) কামরুল ইসলামকেও এক মামলায় একই সাজা দেয়া হয়েছে। রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) হাফিজুর রহমান এক মামলায় পেয়েছেন এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক মাস কারাভোগ করতে হবে তাকে। রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) হাবিবুর রহমান সবুজ ও মাজহারুল ইসলামকেও এক মামলায় একই সাজা দেয়া হয়েছে।
রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) নায়েব আলী শরীফ দুই মামলায় পেয়েছেন ১ বছর করে মোট ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। ৫ হাজার টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও ১ মাস করে ২ মাসের কারাভোগ করতে হবে তাকে। রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে ৩ মামলায় ১ বছর করে মোট ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ৫ হাজার টাকা করে মোট ১৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক মাস করে কারাভোগ করতে হবে তিন মাস। আসামিদের মধ্যে একমাত্র আসামি খুরশীদ আলম কারাগারে রয়েছেন। রায় ঘোষণার সময় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। রায় শেষে সাজা পরোয়ানা দিয়ে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হয়। আদালতকে সম্মান দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করায় তাকে লঘু শাস্তি দেয়ার কথা জানিয়েছেন বিচারক। অপর আসামিরা পলাতক থাকায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেয়ার অভিযোগে মোট ছয়টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, ভাগ্নি বৃটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী ও ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে আসামি করা হয়। ছয় মামলাতেই শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার প্লট মামলায় ১২ জন, জয়ের প্লট মামলায় ১৭ জন ও পুতুলের প্লট মামলায় ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। আসামিদের বেশির ভাগই একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে তাদের সংখ্যা ২৩। চলতি বছরের ৩১শে জুলাই হাসিনা পরিবারের তিন মামলায় ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। চার মাসের মাথায় গত ২৩শে নভেম্বর এসব মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করা হলো।
হতাশ দুদকের আইনজীবী: আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দুদকের আইনজীবী খান মো. মাইনুল হাসান লিপন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করেছিলাম, কিন্তু আদালত আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করেনি। কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী হয়েও প্লটের লোভও সামলাতে পারেননি: বিচারক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ফাইনালি প্লট বুঝিয়ে দিতে দরখাস্ত দিলেন শেখ হাসিনা। সম্পদের প্রতি তার লোভ আছে। না হলে আবেদনটি ছুঁড়ে ফেলতে পারতেন। বলতেন প্লট দরকার নাই। তা না করে প্লট বুঝে নিতে আবেদন করেন। পরে প্লটটি চূড়ান্তভাবে তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। এখানে রাজউক এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অন্যায় করেছে। শেখ হাসিনা অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত, প্রতারণা করেছেন। তিনি এটা না পেলে কোনো সৎ লোক হয়তো পেতেন। তিনি ৩রা আগস্ট প্লট পান। দুঃখজনক ৩১শে আগস্ট তিনি ছেলে জয়ের জন্যও প্লটের রিকমেন্ড করলেন। তিনি একজন পলিটিক্যাল লিডার, চারবারের প্রধানমন্ত্রী। তার কেন এতো টাকা, এতো সম্পদ লাগবে? তারা এসব সম্পদ না পেলে তো অন্য কেউ পেতেন। এরপর ১১ই সেপ্টেম্বর তিনি তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের জন্য প্লটের রিকমেন্ড করে চিঠি দিলেন। তিনিও (পুতুল) প্লট পেলেন। ছেলে-মেয়ের পর তিনি বোন, বোনের ছেলে-মেয়ের জন্য প্লটের রিকমেন্ড করলেন।
খবর বাংলাদেশ ডেস্ক : 
























