মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় চার বছর আগেই কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি) হতে মনোনয়নপত্র কিনেছেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. জাফর আলী। কুড়িগ্রাম-২ আসনের জন্য দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। এর আগেও নবম সংসদের একজন সাংসদ ছিলেন তিনি।
জাফর আলী ছাড়াও আরও অন্তত ১২ জন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে এমপি হওয়ার আশায় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বলে গতকাল রাতে স্থানীয় সরকার বিভাগ নিশ্চিত করেছে।
এর বাইরে অন্তত একজন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং দুজন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনোনয়নপত্র কিনেছেন। কিন্তু এখনো তারা পদত্যাগ করেননি। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে আরও প্রায় ডজনখানেক জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রয়েছেন, যাদের মনোনয়নপত্র কেনার সম্ভাবনা রয়েছে।
আইন অনুযায়ী জেলা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না থাকায় অনেকেই স্বেচ্ছায় পদ ছাড়ছেন। তবে পদত্যাগ না করে যারা মনোনয়নপত্র নিয়েছেন, তাদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হলে পদত্যাগ করতে হবে।
ক্ষমতা, পদ, পদবি, স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যদের দীর্ঘদিন ধরেই দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এ নিয়ে অনেক চেয়ারম্যানের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ক্ষোভ রয়েছে। এসব ক্ষোভের কথা তারা বিভিন্ন সময় সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও অবহিত করেছেন। এসব ক্ষোভের কারণেই কেউ কেউ এমপি হতে ইচ্ছুক বলে জানা গেছে।
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চেয়ারম্যান পদ শূন্য হলে সেখানে নতুন করে নির্বাচন দিতে হবে। তার আগপর্যন্ত কাউকে ভারপ্রাপ্ত বা চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। নতুন করে নির্বাচন মানেই সেখানে আবার রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়ার পাশাপাশি নানারকম জটিলতার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া সাময়িক সময়ের জন্য নাগরিক সেবাও বিঘ্ন ঘটে। অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিদের এমপি হওয়ার এ ইচ্ছার কারণে সব ধরনের নেতিবাচক দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের কাঁধেই পড়ে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের দিকে কে তাকায়? সবাই এখন এমপি হতে চায়। এটাতে তাদের অধিকার আছে। আর এখন তারা সুযোগও পেয়েছে। মার্কাটা পেলেই হলো। নির্বাচন হয়ে যাবে। সহজে এমপি হয়ে যাবেন। এ সুযোগ ছাড়বে কেন? কারও কোনো দায়বদ্ধতা নেই। দায়বদ্ধতার যুগ শেষ। এখন সুবিধাবাদীর যুগ। সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। অনেক চেয়ারম্যান টাকাওয়ালা। উপজেলায় ঠিকমতো যান না। তিনি এখন টাকা দিয়ে সবকিছু কিনে নেবেন। এগুলো নিয়ে আসলে কিছুই করার নেই।’
কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করে এমপি নির্বাচনে ইচ্ছুক জাফর আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখান থেকে জাতীয় পার্টির যিনি এমপি হয়েছেন তিনি এলাকায় ভালো কাজ করেননি। মানুষ সবাই আমাকে নির্বাচন করতে বলে। সেজন্যই মনোনয়নপত্র কিনেছি। এখন নেত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন। এর আগেও তো আমি এমপি ছিলাম। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি অনেক উন্নয়ন করেছি। কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি নেই। আমি সারা জীবন নিজে কষ্ট করে মানুষের সেবা করে গেলাম।’
মেয়াদ শেষ হওয়ার চার বছর আগেই পদত্যাগ করার ফলে সেখানে আবার উপনির্বাচন করতে হবে। এতে কি রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হবে না? জবাবে তিনি কিছু সময় চুপ থেকে বলেন, ‘মানুষ সেবা চায়। সেজন্যই আবার এমপি হতে ইচ্ছুক। আমি জমি বিক্রি করে মানুষের উপকার করে আসছি। আশা করি মনোনয়ন পাব।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উপনির্বাচনের কারণে নতুন করে আবার ওইসব এলাকায় ব্যয় বাড়বে এটা ঠিক। কিন্তু এগুলো তাদের অধিকার। এটা কাক্সিক্ষত নয়। যারা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছে তাদের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ করাই উচিত। যদিও তাদের দলীয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এটা অনাকাক্সিক্ষত কিন্তু অবৈধ নয়।’
সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নুরুল হুদা মুকুট দায়িত্ব গ্রহণের পর পাঁচ বছরের মেয়াদের মধ্যে এখন পর্যন্ত এক বছরও পূর্ণ হয়নি। তার আগেই তিনি এমপি হতে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তবে তিনি চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেননি।
নুরুল হুদা মুকুট দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরপর দুবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হলাম। এখন সংসদ সদস্য হতে চাই। মনোনয়ন ফরম কিনেছি। নেত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই মেনে নেব।’ মেয়াদ আর কতদিন আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো এক বছর পূর্ণ হয়নি। মনোনয়ন পেলে চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করব।’ তবে চেয়ারম্যান হিসেবে কবে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন সেটা নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কোনো জনপ্রতিনিধি যেকোনো সময় তার পদ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন। আইনে যেহেতু নিষেধ নেই এবং নিজেরা ঝুঁকি (মনোনয়ন না পাওয়া কিংবা জয়ী না হওয়ার ঝুঁকি) নিয়ে চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে এমপি হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করছেন, সুতরাং এটাতে দোষের কিছু দেখি না।’
নেত্রকোনা-১ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আশায় দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌস আরা ঝুমা তালুকদার। জানতে চাইলে গতকাল রাতে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গতবার যখন আমি সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে পাইনি তখন আমাকে জোর করে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। দুর্গাপুরের জনগণ চায় তাদের পাশে আমি যেন এমপি হিসেবে থাকি, সেজন্যই মনোনয়ন চেয়েছি।’
জোর করে চেয়ারম্যান করার বিষয়টি পরিষ্কার হতে চাইলে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘গতবার উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তাই আমাকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার জন্য দল (আওয়ামী লীগ) থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়। আমি স্বতন্ত্র নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হই। পরে তো দলীয়ভাবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে আরও যারা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন তারা হলেন টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার ইউনুস ইসলাম তালুকদার, সাভার ধামরাইয়ের মোহাদ্দেস হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের এসএম আল মামুন, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের জাহিদুল ইসলাম রোমান, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা মো. শফিকুল ইসলাম শফি, সুনামগঞ্জের শাল্লার চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ওরফে আল আমিন চৌধুরী, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এমএ মোতালেব।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জের সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খায়রুল হুদা চপল এবং তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল পদত্যাগ না করেই দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া সাভার উপজেলার আশুলিয়ার স্বনির্ভর ধামসোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামও তার পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন এমপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য।